আগামী ২২, ২৩ ও ২৪ মে বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির একাংশ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সেই ধর্মঘট আদৌ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা সময়ে ধর্মঘটের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বেসরকারি বাসমালিকেরা। তাতে সফল হয়েছেন মাত্র এক বার। বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে পাঁচ বার বেসরকারি বাস ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল নানা সময়। মদন মিত্র পরিবহণমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথম বার ২০১২ সালের জুলাই মাসে বাসভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলেও, পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তা স্থগিত করা হয়। ফের ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে, বাসমালিক সংগঠনগুলি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর তা প্রত্যাহার করা হয়।
২০১৪ সালে শিলিগুড়িতে বেসরকারি বাস সংগঠনগুলি এক ছাতার তলায় এসে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে তিন দিনের বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সে বছর জুন মাসে ৭২ ঘণ্টার বাস ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সে বার এক দিনের জন্য ধর্মঘট করেওছিলেন বেসরকারি বাসমালিকেরা। কিন্তু ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন পরিবহণমন্ত্রী মদনের আশ্বাসের পর তা স্থগিত করা হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বাসমালিক সংগঠনগুলি ধর্মঘটের হুমকি দিলেও সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর তা প্রত্যাহার করে। সেই সময় রাজ্যে পরিবহণমন্ত্রী না থাকায় গোটা বিষয়টি সামাল দিয়েছিলেন তৎকালীন পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার করোনা সংক্রমণের সময় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে, তিন দিনের বাস ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল, যা মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রত্যাহার করা হয়।
উল্লেখ্য, অনেক সময় ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলেও, শেষ মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের অস্থায়ী কর্মীরা প্রায় এক সপ্তাহের কর্মবিরতি পালন করেন, যা পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর আশ্বাসের পর প্রত্যাহার করা হয়। ২০১১ সাল থেকে একাধিক বার পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে, প্রধানত বাসভাড়া বৃদ্ধি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, এবং প্রশাসনিক সমস্যার প্রতিবাদে। আগামী ২২, ২৩ এবং ২৪ মে তারিখে পশ্চিমবঙ্গে তিন দিনের বেসরকারি বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহণ বাঁচাও কমিটি। এই ধর্মঘটে অংশ নিচ্ছে পাঁচটি বাসমালিক সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট (পশ্চিমবঙ্গ), বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট, ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং ইন্টার অ্যান্ড ইন্ট্রা রিজিয়ন বাস অ্যাসোসিয়েশন।
তাদের দাবি, ১৫ বছরের পুরনো বাস বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে হবে, কারণ কোভিড-১৯ মহামারির সময় দু’বছর বাস চলাচল বন্ধ ছিল। পাশাপাশি, পুলিশি হয়রানি এবং ইচ্ছামতো টোল ট্যাক্স আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। ডিজ়েলের মূল্যবৃদ্ধি এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধান চেয়ে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। বাসমালিকেরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ২০ মে-র মধ্যে যদি তাঁদের দাবিগুলির বিষয়ে সদর্থক পদক্ষেপ না করা হয়, তবে ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টা বেসরকারি বাস পরিষেবা বন্ধ থাকবে। এই ধর্মঘটের ফলে নিত্যযাত্রীরা বড়সড় সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই বিকল্প পরিবহণের ব্যবস্থা করার জন্য যাত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বস্তুত, রাজ্য সরকার যে কোনও ধরনের ধর্মঘটের বিরোধী। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এ রাজ্য থেকে ধর্মঘট সংস্কৃতি তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী। তাই ধর্মঘটের পরিস্থিতি আগাম অনুমান করে সোমবার কসবার পরিবহণ ভবন-২ -এ বাসমালিক সংগঠনগুলিকে নিয়ে বৈঠকে বসছে পরিবহণ দফতর। তবে এমনও কিছু বাস সংগঠন রয়েছে, যারা এই ধর্মঘটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। সিটি সাবার্বান বাস সার্ভিসের তরফে টিটু সাহা বলেছেন, ‘‘ধর্মঘট সংক্রান্ত যে বৈঠক পরিবহণ দফতর ডেকেছে, আমরা সেখানে গিয়ে সব পক্ষের মতামত শুনব এবং নিজেদের মতামত জানাব।’’ তবে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে ধর্মঘটের পথে যেতে নারাজ এই বেসরকারি বাস সংগঠনটি। পশ্চিমবঙ্গ বাস মিনিবাস সমন্বয় সমিতির তরফে রাহুল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এ ভাবে ধর্মঘট করে কিছু আদায় করা যায় না। বেসরকারি বাস নিয়ে গ্রিন ট্রাইব্যুনাল কলকাতা হাইকোর্ট এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। তাই আমাদের উচিত সেই সব মামলায় অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করা। তবে পরিবহণ দফতর যে বৈঠকের ডাক দিয়েছেন, তাতে গিয়ে অবশ্যই নিজেদের অবস্থান জানানো হবে।’’
আরও পড়ুন:
বৈঠকের আগে ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির একাংশ মতামত পোষণ করায় কিছুটা হলেও ‘ব্যাকফুটে’ ধর্মঘট আবেদনকারীরা। তবে ধর্মঘট আহ্বানকারীদের অন্যতম মুখ জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পরিবহণ দফতরের বৈঠকের ডাক দিয়ে আমাদেরকে চিঠি দিয়েছে। সেই বৈঠকে আমরা যাব, কিন্তু ওই চিঠিতে বৈঠকের বিষয়বস্তুর কথা উল্লেখ করা হয়নি। ধর্মঘট নিয়ে আমাদের অবস্থান কী হবে তা বলা এখনই ঠিক হবে না।’’ আর মিনিবাস অপারেটর্সের স্বপন ঘোষ বলেন, ‘‘ধর্মঘট নিয়ে জট খোলা বেশ কষ্টকর। কারণ, আমরা মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছি। আর বৈঠক ডেকেছেন পরিবহণসচিব, তাই মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া ধর্মঘট নিয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে তা বলা এখনই সম্ভব নয়।’’