Advertisement
E-Paper

অসহায় রোগী, ত্রাতা ‘এজেন্ট’, লক্ষ লক্ষ টাকায় পাওয়া যায় কিডনির ‘দাতা’!

কিডনির বাজারে শুধুই অনিয়ম আর প্রতারণাএখন বলছেন, ‘‘এটাও আমার আস্তানা নয়। দিন কয়েক এখানে থাকব। তার পরে অন্য কোথাও।’’ কেন? চুরি, ডাকাতি না কি খুন?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:২৪
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বাঁকুড়ার লালবাজারের গলি, তস্য গলি পেরিয়ে এক চিলতে ঘর। অনিচ্ছায় টুল পেতে বসতে দেওয়া হল। তবে ঘরের বাইরে। এই প্রথম মুখোমুখি। আগে অন্তত বার পাঁচেক দিনক্ষণ স্থির করেও শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছেন। জোর করলে বলেছেন, ‘‘আর তো কিছু বাকি নেই। পুলিশে ধরলে সংসারটা ভেসে যাবে।’’

এখন বলছেন, ‘‘এটাও আমার আস্তানা নয়। দিন কয়েক এখানে থাকব। তার পরে অন্য কোথাও।’’ কেন? চুরি, ডাকাতি না কি খুন?

৪৫ বছরের দেবু হালদার (নাম পরিবর্তিত) নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেছেন তিন বছর আগে।

স্থানীয় কারখানার শ্রমিক দেবুবাবু কাজ হারিয়েছিলেন আচমকা। তার পরেই একমাত্র সন্তানের দুরারোগ্য অসুখ ধরা পড়ে। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। সেই সময়েই এলাকার এক বাসিন্দা মারফত যোগাযোগ হয় বাঁকুড়ারই এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কিডনি বিক্রির প্রস্তাবটা তিনিই দেন।

তার পর?

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেবু বলেন, ‘‘১৫ হাজার টাকা আর রূপসী বাংলার টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, হাসপাতালে গেলে আরও ৩৫ হাজার পাব। কাজ হয়ে গেলে আরও এক লাখ।’’ পেয়েছিলেন? ‘‘হাসপাতালে গিয়ে কিছু পাইনি। অপারেশনের পরে ২০ হাজার টাকা আর ভোরের ট্রেনের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খুব চেঁচিয়েছিলাম আমি। লোকটা বলেছিল, কথা বাড়ালে পুলিশে দেবে। কারণ, আমরা বেআইনি কাজ করেছি।’’ বললেন দেবুর স্ত্রী সুমিত্রা। দেবু বললেন, ‘‘টাকা পেলাম না। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারলাম না। নিজের শরীরটাও মনে হয় কমজোরি হয়ে গেল।’’

নিয়ম কী আইনত অঙ্গ বেচাকেনা নিষিদ্ধ। তাই কিডনিও কেনা যায় না। কাগজে-কলমে যদি কেউ দান করেন, তবেই তা পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা-ভাই-বোন-সন্তান-স্বামী-স্ত্রীর অগ্রাধিকার। পরের ধাপে অন্য আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য ভবনের অনুমতি দরকার হয়। দাতা যেখানে থাকেন সেই ঠিকানার শংসাপত্রও লাগে। স্বাস্থ্য ভবনের পরিদর্শকেরা বাড়ি ঘুরে তথ্যের সত্যতা যাচাই করেন। দাতার সঙ্গে গ্রহীতার অঙ্গ ‘ম্যাচ’ করলে তবেই বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ‘ম্যাচ’ করানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা রয়েছে।

দেবুর কাছে ঠিকানা পেয়ে খুঁজে খুঁজে পৌঁছনো গেল সেই ব্যবসায়ীর বাড়িতে। তিন তলা, ঝাঁ চকচকে বাড়ি। গ্যারাজে দুটো গাড়ি। তিনি বাড়িতে নেই। বাড়ির অদূরেই তাঁর ছোট্ট মিষ্টির দোকান। সেখানে রয়েছেন। ওইটুকু দোকান চালিয়ে এত বড় বাড়ি? দোকান সামান্য ফাঁকা হতে হাসিমুখে ভিতরে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন ব্যবসায়ী। তার পর বললেন, ‘‘সাংবাদিক হন আর যে-ই হন, কিচ্ছু করতে পারবেন না। যারা কিডনি বেচেছে, মুখ খুললে নিজেরাই বিপদে পড়বে। দু’চার বার চেষ্টা হয়েছিল। পরে সবাই পিছিয়ে গিয়েছে।’’

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওই ব্যবসায়ী শুধু বাঁকুড়া জেলাতেই গত দু’বছরে অন্তত সাতটি কিডনি বিক্রির ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।

জোর গলায় তিনি নিজেই জানালেন, যাঁর কিডনি, তিনি কোনও ক্ষেত্রেই ৫০ হাজারের বেশি পাননি। আর ব্যবসায়ী নিজে কত পেয়েছেন? কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে খোঁজখবর বলছে, সেখানে এক একটি কিডনির জন্য ছ’ থেকে সাত লক্ষ টাকা দাম পাওয়া যাচ্ছে। মিষ্টির দোকান চালিয়ে ঝাঁ চকচকে বাড়ির রহস্য ততক্ষণে স্পষ্ট।

ব্যবসার আরও খুঁটিনাটি জানা গেল পুরুলিয়ার এক দালালের কাছে। তিনি জানালেন, ব্যবসা দু’রকম ভাবে হয়। এক, যিনি কিনছেন, তিনি পুরো টাকাটাই দালালকে দিলেন। তার পর দালাল যাঁকে যা দেওয়ার দেবেন। ক্রেতার শুধু ‘সার্ভিস’ অর্থাৎ কিডনিটা পেলেই হল। দুই, দালাল শুধু বিক্রেতার সঙ্গে ‘পার্টি’ অর্থাৎ ক্রেতার যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। দালালকে ‘প্রসেসিং ফি’ দিতে হবে। বাকিটা ক্রেতা-বিক্রেতা দরাদরি করে বুঝে নেবেন। প্রসেসিং ফি কেমন হয়? পুরুলিয়ার ওই দালাল বললেন, ‘‘তিন থেকে চার লাখ তো হয়ই। বাকি একটা বড় অঙ্কের টাকা হাসপাতালের অনেককে দিতে হয়।’’

রাজ্যের বিভিন্ন জেলার কিডনি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে যে সব দালালের হদিস মিলেছে, তাঁদের মধ্যে কে নেই! বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিক, সরকারি চাকুরে, স্কুল শিক্ষক, ব্যাঙ্ক কর্মী, এমনকী, এনজিও কর্মীও আছেন। ‘কিডনি দান করতে আগ্রহী’ সংক্রান্ত যে সব বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে বেরোয়, তার অনেকটাই দালালদের বিজ্ঞাপন। রোগী বা তাঁর পরিবারের তরফে যোগাযোগ করা হলে ধাপে ধাপে সেটা স্পষ্ট হয়। প্রথম দিকে কথায় সৌজন্য থাকে। কথা যত এগোয়, সে সব খসে পড়ে। কিডনি জোগাড়ের ক্ষেত্রে রোগীর অসহায়তার কথা বুঝে শুরু হয় শর্ত আরোপ। কিডনি বিক্রি করছেন যিনি, তিনিও যেমন টাকার জন্য দালালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, রোগীর ভরসাও দালালরাই। চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালকর্মীদের এক অংশও নিজেদের বখরার জন্য দালালকেই তোষামোদ করে চলেন।

রকমফের আছে এ সব দালালের। কেউ এজেন্ট, কেউ বা সাব-এজেন্ট নামে পরিচিত। বিক্রেতা জোগাড় করে দেওয়া, স্বাস্থ্য ভবনে ‘দাতা’ ও ‘গ্রহীতা’র আবেদন জমা দেওয়া, অনুমোদন আদায় করা, বিক্রেতাকে হাসপাতালে হাজির করা, হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স, এমনকি, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ‘ফিট’ করা— সব কাজই করেন তাঁরা। কাগজে-কলমে অবশ্য সকলেই দাতা!

তবে সব ঝামেলা মিটিয়ে ‘দাতা’ এবং গ্রহীতা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেও শেষ হয় না ভোগান্তির। বরং কোনও কোনও সময়ে শুরু হয় ভোগান্তির নতুন অধ্যায়। বহু ক্ষেত্রে কিডনি বিকল হওয়া রোগী ডায়ালিসিস করতে গিয়ে হাসপাতালে যে চক্রের মুখোমুখি হন, তার শিকড় এক ‘ভবনে’!

Kidney Kidney Racket Organ Smuggling Hospital Patients
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy