Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দিনদুপুরে ভরা রাস্তায় ‘আমরা সবাই চোর’

হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড। অনেকের গলায় ঝুলছে অ্যাপ্রন। দাবি? ‘আমরা সবাই চোর। আমাদের গ্রেফতার করুন’! এমন মিছিল বোধহয় প্রথম দেখল কলকাতা! বলিউডি ছবির লব্জে ‘হাম সব চোর হ্যায়’ অপরিচিত নয়। কিন্তু সেটাই রাজনীতির স্লোগান হয়ে উঠে এসে অপেক্ষমান নিত্যযাত্রী থেকে কর্তব্যরত পুলিশ, সকলের জন্যই কৌতুক এবং বিস্ময়ের উপাদান জুগিয়ে দিল সোমবার।

মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে। সোমবার  সন্দীপন চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে। সোমবার সন্দীপন চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৫
Share: Save:

হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড। অনেকের গলায় ঝুলছে অ্যাপ্রন। দাবি? ‘আমরা সবাই চোর। আমাদের গ্রেফতার করুন’!

এমন মিছিল বোধহয় প্রথম দেখল কলকাতা! বলিউডি ছবির লব্জে ‘হাম সব চোর হ্যায়’ অপরিচিত নয়। কিন্তু সেটাই রাজনীতির স্লোগান হয়ে উঠে এসে অপেক্ষমান নিত্যযাত্রী থেকে কর্তব্যরত পুলিশ, সকলের জন্যই কৌতুক এবং বিস্ময়ের উপাদান জুগিয়ে দিল সোমবার। মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকে মিছিলের জেরে আটকে-থাকা এক রোগীর আত্মীয় যেমন বলছিলেন, “চুরি করে ধরা পড়ছে। তার জন্য আবার মিছিল!” কলকাতা পুলিশের এক অফিসারকেও সহকর্মীদের কাছে বলে ফেলতে শোনা গিয়েছে, “সিবিআই তার কাজ করছে। তার জন্য কাজের দিনে মিছিলে মুখ্যমন্ত্রী! এমন জিনিস দেখতে হবে, ভাবিনি!”

ভাবেননি তৃণমূলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরাও। তাঁরা শুধু জানেন, দলনেত্রী ডাক দিয়েছেন। দলে-দঙ্গলে রাস্তা ভরিয়ে দলনেত্রীর নির্দেশ পালন করতে হবে। সে কাজ করতে গিয়ে নিজেদেরই হাস্যাস্পদ করে তোলা হবে কি না, এ ভাবনার এক্তিয়ার তাঁদের ছিল না! বিরোধীরাই বরং তৃণমূল কর্মীদের ‘অসম্মানে’র কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “তৃণমূলের সবাইকে চোর কিন্তু কেউ বলেনি। তৃণমূল নেত্রীই দলের সবাইকে চোর বলে দেগে দিলেন!” সেলিম তুলে আনছেন আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প, যেখানে দস্যুরা আলিবাবার বাড়ি চিনে কাটা চিহ্ন দিয়ে গিয়েছিল। আর, মর্জিনা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য সব বাড়িতে একই রকম চিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন বলতে চেয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রই তাঁকে এই ভাবে পথে নামতে বাধ্য করেছে। কেন্দ্রের হাবভাবে যেন মনে হচ্ছে, তৃণমূলের সবাই চোর! এই চক্রান্তের প্রতিবাদ জানাতেই পথকে বেছে নিয়েছেন তাঁরা। সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে কলেজ স্কোয়ার থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিলে এ দিন অবশ্য লোক হয়েছিল চোখে পড়ার মতোই। বনগাঁ থেকে হেলিকপ্টারে তড়িঘড়ি কলকাতা ফিরে যোগ দিয়েছিলেন মমতা। মিছিল শেষে বলেছেন, “এই জনস্রোত কাকে দিয়ে আটকাবেন? আমি রাস্তার লোক, এখনও রাস্তায়!”

রাস্তার লোকেরা কিন্তু মমতাকে পথে দেখে সেই আগের মতো আপ্লুত হয়ে যাননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকে ছোট মঞ্চ বেঁধে মিছিলকে রওনা করাচ্ছিলেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে, পরিষদীয় সচিব তাপস রায়রা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের লাগোয়া ফুটপাথে এক পড়ুয়ার সবিস্ময় প্রশ্ন ছিল, “এরা গ্রেফতার হতে চায়। এত পুলিশ আছে। গ্রেফতার করছে না কেন?” সতীর্থ পড়ুয়া ভুল ভাঙিয়ে দিলেন, “ধরবে কী করে? এদের ধরলে পুলিশের মার খাওয়ার ভয় আছে না? আলিপুরে দেখিসনি!”

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ সব কিছুই দেখেননি। ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি হুঙ্কার ছুড়ে দিয়েছেন, “আমরা সবাই চোর! গ্রেফতার করো! এই তো প্রকাশ্যেই দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, কত বড় জেল বানাতে পারো!” বলাই বাহুল্য, গ্রেফতার করার লোক ধারেকাছে ছিল না। বরং পড়ন্ত বিকেলে ডোরিনা ক্রসিংয়ের সিগনাল পোস্টে বেজে যাচ্ছিল, ‘রইল না, রইল না.. সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’! স্রেফ সমাপতন গুণেই সে গানের কলি তখন অনেকের কাছেই প্রতীকী!

কলকাতা শহরের নানা ওয়ার্ড তো বটেই, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হাওড়ার শহরতলি থেকে লোক এসেছিল মিছিলে। গত ৪৮ ঘণ্টায় মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, ফিরহাদ (ববি) হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, তাপস রায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের পরিশ্রম ছিল তার পিছনে। এক মন্ত্রীর কথায়, “মমতা লোক ভালবাসেন। বিষয় যেমনই হোক, এত লোক দেখলেন মানেই মমতা চাঙ্গা।” কাল, বুধবার আবার লেখক-শিল্পী-অভিনেতাদের মিছিল। যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নব্য তৃণমূলপন্থী অরিন্দম শীলকে। শহিদ মিনার ময়দানে ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা ১ ডিসেম্বর। সব মিলে শাসক দল এখন লাগাতার রাস্তায়। দলের এক বিধায়কের মতে, “একের পর ঘটনায় দলের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে একটা অবসাদ তৈরি হয়েছে, এটা অনস্বীকার্য। এই মিছিল করে আসলে সেই অবসাদ কাটানোর চেষ্টা হল।” নেতারা বলছেন বটে। কিন্তু মিছিল শেষে তৃণমূল নেত্রী যখন বলছেন, “ভালবেসে বললে আমি বাড়ির বাসনও মেজে দিয়ে আসব,” উপস্থিত কর্মী মহলে অবসাদ কাটার কোনও ইঙ্গিত অন্তত চোখে পড়েনি!

কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ ছাড়াও মিছিলের বিরাট উপকরণ ছিল এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম-বিরোধী জিগির। সেই মর্মে রীতিমতো ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড, কার্টুন সবই মজুত ছিল। দলনেত্রীর মুখে ‘বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম’ সম্ভাষণ শুনে তৃণমূলের বহু পুরনো সহযোদ্ধাও চমকে গিয়েছেন। তৃণমূল হয়ে ওঠার পথে শাসক সিপিএমের মুখেই তাঁরা এমনটা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। অভ্যাসের বদল তাঁদেরও হকচকিয়ে দিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE