প্রবল চাপের মুখে আলু কেনার সহায়কমূল্য ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। আশ্বাস দিল, এ বার থেকে আলু রফতানিতে ভর্তুকি দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে মিলল হিমঘরে যত দূর সম্ভব আলু মজুত করার জায়গা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। যা শুনে আলু-চাষি, ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এবং বিরোধীদের বক্তব্য, “সরকারের টনক আগে নড়লে, রাজ্যে এই অশান্তির পরিস্থিতিই তৈরি হতো না।” তাঁদের সংযোজন, “ধান কেনা নিয়েও সরকার নানা আশ্বাস দেয়। কিন্তু বাস্তবে সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হলেও নানা কারণে তার সুফল পান না প্রান্তিক চাষিরা। খেয়াল রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রেও যেন তা না হয়।”
রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বুধবার বলেন, “চাষিদের থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন আলু কেনা হবে। সেই আলু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং মিড-ডে মিলে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া, চাষি বা ব্যবসায়ী যাঁরাই মালগাড়িতে দক্ষিণবঙ্গের জন্য আলু পাঠাবেন তাঁদের কুইন্টাল প্রতি ৫০ টাকা এবং উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা সরকার ভর্তুকি দেবে। জাহাজে বিদেশে আলু পাঠানোর জন্য প্রতি কুইন্টালে ১০০ টাকা ভর্তুকি থাকবে।”
চলতি মরসুমে ভাল আবহাওয়া থাকায় এবং সে ভাবে রোগ বা পোকার আক্রমণ না হওয়ায় রাজ্যে আলুর ফলন অনেকটাই ভাল। গত বার ছিল ৮৫ লক্ষ টন। এ বার সেখানে আলুর ফলন হয়েছে ১ কোটি ২০ লক্ষ টন। কিন্তু এ রাজ্যের সব হিমঘর মিলিয়ে মাত্র ৭৪ লক্ষ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। এই আবহে হিমঘরের জায়গা পাওয়ার জন্য শুরু হয় চাপাচাপি। আলুর দাম নামতে শুরু করে। এ দিনও আলু রাখার জায়গা না পেয়ে হুগলির পাণ্ডুয়ায় এক হিমঘরের ম্যানেজারকে দীর্ঘক্ষণ তালাবন্দি করে রাখেন কিছু চাষি। জিটি রোডে দীর্ঘক্ষণ অবরোধও করেন। তবে সরকারি ঘোষণার পরে এলাকা ঠান্ডা হয়।
পরিস্থিতির জন্য আলু সংরক্ষণ, রফতানি এবং বিপণনের ক্ষেত্রে সুসংহত নীতি প্রণয়নে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ারা। বিরোধী নেতারা এবং আলু চাষি ও ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, এ রাজ্যের উৎপাদিত আলু রফতানি করা নিয়ে নানা সময়ে নানা নীতি নিয়েছে রাজ্য। তাঁদের যুক্তি, গতবার ওড়িশা, অসম, ঝাড়খণ্ড, বিহারে সে ভাবে আলুর ফলন হয়নি। কিন্তু রফতানি বেড়ে গেলে রাজ্যে আলুর দাম বেড়ে যাবে এই যুক্তিতে সরকার ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোয় রাশ টানে। ফলে, ওই সব রাজ্যের ব্যবসায়ীদের অনেকের মধ্যে এ রাজ্য থেকে আলু কেনা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। তার উপরে এ বার ওই রাজ্যগুলিতেও আলুর ফলন ভাল হওয়ায় কার্যত রফতানি করার বাজারটিই সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী এ বার ৫০ লক্ষ টন পর্যন্ত আলু রফতানি করার ছাড়পত্র থাকলেও বাজার না পাওয়ার ভয়ে মাঠ থেকে আলু কিনছেন না ব্যবসায়ীরা।
এই অবস্থায় এ দিন নবান্নে কৃষিমন্ত্রী পুর্ণেন্দু বসু ঘোষণা করেছেন, রাজ্য থেকে আলু বাইরে পাঠানোর ব্যাপারে যে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা সরকারি নির্দেশিকা জারি করে তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু কলকাতার বাজারে সরকারি বিপণনকেন্দ্রগুলির জন্য আলাদা করে পাঁচ টাকা কেজি দরে আলু কেনা হবে। তা বিক্রি করা হবে কেজিতে দু’টাকা লাভে। এই খাতে প্রতিদিন ১০-১৫ টন আলু কৃষক সমবায় বা সরাসরি মাঠ থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কতদিন সে প্রক্রিয়া চলবে তা জানাননি পূর্ণেন্দুবাবু। কৃষিবিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়ের সংযোজন, সাধারণত সরকার হিমঘরগুলিতে ১০ শতাংশ জায়গা সংরক্ষণ করে রাখে। এ বার তা কমিয়ে দুই শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে, হিমঘরগুলিতে চাষিরা বাড়তি জায়গা পাবেন।
আলুর অতিফলন এবং দাম না পাওয়াএই সাঁড়াশি চাপের পরিস্থিতিতে মঙ্গলবারই হুগলি এবং বর্ধমানে আত্মঘাতী হন দুই চাষি। সে প্রসঙ্গ টেনে এ দিন এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু দাবি করেছেন, আত্মঘাতীদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে ওই দুই কৃষকের আত্মহত্যার সঙ্গে সরাসরি আলুর দাম না পাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই বলে এ দিন পাল্টা দাবি করেছেন রাজ্যের দুই মন্ত্রীঅরূপ এবং পুর্ণেন্দু। যদিও বিরোধী নেতা থেকে শুরু করে আলু চাষ এবং ব্যবসায় জড়িতদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, আত্মহত্যাগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার আগে এ রাজ্যে আলুচাষ এবং চাষিদের সামগ্রিক পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। রফতানি নিয়ে নির্দিষ্ট নীতির অভাব, হিমঘরের সংখ্যা না বাড়া, বিকল্পে চাষে সরকারি উৎসাহ কার্যকরী ভাবে চোখে না পড়া, ব্লকে ব্লকে কিসান মান্ডি চালু না হওয়া, চাষির কাছ থেকে শহরের বাজারে পৌঁছনো পর্যন্ত আলুর দাম বাড়ানোয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ কার্যত না থাকাসব মিলিয়েই রাজ্যের আলু চাষিদের একটা বড় অংশ বিপন্ন বলে মনে করছেন তাঁরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “চাষিদের সমস্যা একই আছে। তাঁরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না।”
সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি যে অমূলক নয়, সে কথা মেনেছেন কৃষিমন্ত্রী অরূপ রায়। তাঁর বক্তব্য, “এ বার সারা ভারতেই আলুর ফলন ভাল। তার ফলেই একটা অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।” কৃষিমন্ত্রীর সংযোজন, “কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন নির্ভর করে প্রকৃতি ও আবহাওয়ার পরিস্থিতির উপরে। তাই আগাম কোনও নীতি নির্ধারণ করা এ সব ক্ষেত্রে সমস্যার।”
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy