Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জেলা জুড়েই ছড়ানো মরা মুরগির কারবার

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মুরগি কি কেবল বাদুড়িয়ার খামারেই মরে?

সুপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০৪:০৩
Share: Save:

মোটরবাইক হোক বা সাইকেল, দু’দিকে ঝোলানো বড় বড় থলে। দুপুর হলেই এদের আনাগোনা বেড়ে যেত। মরা মুরগির কারবার নিয়ে হইচই শুরু হতেই তাদের আর দেখা যাচ্ছে না বাদুড়িয়ায়। পুলিশ বলছে, ওরাই ছিল মরা মুরগির ‘ক্যারিয়ার’।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মুরগি কি কেবল বাদুড়িয়ার খামারেই মরে?

উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় সব চেয়ে বেশি সংখ্যক খামার রয়েছে বাদুড়িয়ায়। পাল্লা দিয়ে খামার বেড়েছে লাগোয়া বসিরহাট ও দেগঙ্গাতেও। পুলিশি তদন্তে উঠে আসছে আরও অনেক এলাকার নাম।

তদন্তে জানা গিয়েছে, সব মরা মুরগি বাদুড়িয়ার নয়। কারবারিদের সং‌গঠিত ‘নেটওয়ার্ক’ রয়েছে। বসিরহাট, দেগঙ্গার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন জায়গার খামার থেকে মরা মুরগি সংগ্রহ করে ফর্মালিন মাখিয়ে তা পাঠানো হত কলকাতায়।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল এলাকাতেও চলছে মরা মুরগির ঢালাও কারবার। তবে এখানে ফর্মালিন মাখিয়ে তা বিকোচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ। এখানে হিমায়িত মুরগির চলই বেশি। তবে মুরগির কারবার সর্বত্রই ছড়িয়েছে। সেই কারণেই শহর ও মফস্‌সলে ৫০-৬০ টাকায় রমরমিয়ে বিকোচ্ছে চিকেন বিরিয়ানি!

প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, মরা মুরগির কারবার শুরু হয়েছিল বছর দশেক আগে। বসিরহাট-বাদুড়িয়ায় সংকর প্রজাতির মাগুর মাছের চাষ হয়। বিভিন্ন খামার থেকে মরা মুরগি কেনা শুরু হয় সেই মাছেদের খাবার হিসেবে। পরবর্তীকালে ফর্মালিন মাখিয়ে মরা মুরগির কারবার শুরু হয়।

কলকাতায় মুরগির মাংসের বেশির ভাগটাই আসে উত্তর ২৪ পরগনা থেকে। বাদুড়িয়ায় প্রায় ১৫ হাজার খামার রয়েছে। দেগঙ্গা এবং বসিরহাট মিলিয়ে আরও ১৫ হাজার।

ফর্মালিনের কুফল

খাদ্যনালীর ক্ষতি

স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি

লিভার ও কিডনির ক্ষতি

শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা

খিঁচুনি হতে পারে

অম্বল হতে পারে

মরা মুরগির কারবারের চাঁই মনিরুল মণ্ডলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, বাদুড়িয়ার আরও কয়েক জন এই কারবার চালাত। ধরপাকড় শুরু হওয়ার পরে তারা গা-ঢাকা দিয়েছে।

পুলিশ জেনেছে, মনিরুল এবং অন্য কারবারিদের নেটওয়ার্ক রীতিমতো সংগঠিত। একটি খামারে রোজ গড়ে তিন-চারটি করে মুরগি মরে। প্রাণী চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এটা স্বাভাবিক। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মুরগি মরার হার বাড়ে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার তারতম্যেই এমনটা হয়।

বিভিন্ন খামার থেকে সেই মরা মুরগি সংগ্রহের লোক রয়েছে। কেউ ‘সাইকেল ক্যারিয়ার’, কেউ বা ‘বাইক ক্যারিয়ার’। একটি মরা মুরগির দাম সাত-দশ টাকা। মুরগির সংখ্যা বেশি হলে দাম কমে।

পুলিশ জানিয়েছে, দেগঙ্গা ছাড়িয়ে বারাসতের কাছাকাছি এলাকা থেকে মরা মুরগি সংগ্রহ করা হয়। ব্যারাকপুর মহকুমার কিছু খামারের সঙ্গেও কারবার শুরু করেছিল বাদুড়িয়া-দেগঙ্গার কারবারিরা। মরা মুরগি কিনে ফর্মালিনে ডুবিয়ে তা বরফ বা ফ্রিজারে রাখা হয়। তার পরে পাঠানো হয় কলকাতায়। ধৃত কারবারিদের জেরা করে পুলিশ নিউ মার্কেটের একটি ঠিকানা পেয়েছে।

ফর্মালিন আসে কোথা থেকে? খামারের ঘর খালি হওয়ার পরে নতুন করে মুরগির বাচ্চা রাখার আগে সেটি ফর্মালিন ছড়িয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। খামার-মালিকেরা ঘরে বসেই ফর্মালিন পেয়ে যায়। সারা জেলায় খামারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করেন বসিরহাটের জনা কয়েক ব্যক্তি। তাঁরাই ফর্মালিন সরবরাহ করেন। এক লিটার ফর্মালিনের দাম পড়ে ৪০০-৫০০ টাকা। এক লিটার জলে ৫০-১০০ মিলি ফর্মালিনের দ্রবণে মুরগি ডুবিয়ে তা সংরক্ষণ
করা হয়।

সম্প্রতি বাদুড়িয়ায় মরা মুরগির কারবারের বিষয়টি নজরে আসে। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ নিয়ে সরব হওয়ার পড়ে নড়েচড়ে বসে পুলিশ-প্রশাসনও। ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মরা মুরগির কারবার বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। প্রাণিসম্পদ বিকাশ বিভাগের সচিবকে বকাঝকাও করেন। এরপরেই উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক অন্তরা আচার্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। কিছু ধরপাকড়ও হয়। তবে কত দিনে এই কারবারে পুরোপুরি রাশ টানা যাবে, তা বুঝতে আরও কিছু সময় লাগবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

মুরগি Chicken Dead
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE