বিজেপি বলছে, ‘সাফাই’ হচ্ছে। কংগ্রেস বলছে, ‘জবাই হচ্ছে গণতন্ত্র’। বাংলার শাসকদল তৃণমূলের বক্তব্য, ‘ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র’। বিষয়— বিহারের ভোটার তালিকায় ‘বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা’ (এসআইআর)। যা আপাতত দেশের রাজনীতির মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ভোটমুখী বিহারে যা পরিচালনা করছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। কারা প্রকৃত ভোটার, কাদের নাম তালিকায় থাকবে, তা নির্ধারিত হচ্ছে কমিশন নির্ধারিত ১১টি নথির ভিত্তিতে। গোটা প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কমিশনের তরফে ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও বিতর্ক থামছে না।
এসআইআর (স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন) বা বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা কী?
নির্দিষ্ট সময়ান্তরে কমিশন এই নিবিড় সমীক্ষা করে। রাজ্যগুলিতে শেষ বার এই সমীক্ষা হয়েছিল ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। বিহারে হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভোটার তালিকায় থাকা নামের মধ্যে কারা মৃত, কারা অন্যত্র চলে গিয়েছেন, কারা ভুয়ো— গভীরে গিয়ে তা সমীক্ষা করে কমিশন। তার পরে তৈরি করে সংশোধিত তালিকা। জুন মাস থেকে বিহারে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে ৫২ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে ভোটার তালিকা থেকে। পরে তা ৫৬ লক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কমিশন বিহারের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করবে আগামী ১ অগস্ট।
কী কী নথি থাকা প্রয়োজন?
বিহারের ক্ষেত্রে ১১টি নথি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কমিশন। অন্যান্য রাজ্যেও এসআইআর হলে নথির সংখ্যা একই থাকবে বলেই মনে করছেন এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আধিকারিকেরা। কারণ, তা না-হলে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। যে ১১টি নথির কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল—
১. আপনি কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারি কর্মচারী বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী হলে আপনার সেই পরিচয়পত্র।
২. আপনার নামে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগের কোনও সরকারি (কেন্দ্র অথবা রাজ্য) নথি। ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, এলআইসি-র নথিও গ্রাহ্য।
৩. জন্মের শংসাপত্র।
৪. বৈধ পাসপোর্ট।
৫. যে কোনও বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া শিক্ষা সংক্রান্ত শংসাপত্র (যেখানে জন্মের সাল এবং তারিখের উল্লেখ রয়েছে)।
৬. সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্থায়ী বসবাসকারীর শংসাপত্র।
৭. তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত হলে তার শংসাপত্র।
৮. জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তালিকায় নাম।
৯. বনাঞ্চলের অধিকারের শংসাপত্র।
১০. রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের তৈরি করা পারিবারিক ‘রেজিস্টার’।
১১. সরকার প্রদত্ত জমি বা বাড়ির নথি (দলিল, পর্চা ইত্যাদি)।
আধার, এপিক, রেশন কার্ড চলবে না কেন?
এসআইআর নিয়ে একগুচ্ছ মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সেই মামলায় গত ১৭ জুলাই শীর্ষ আদালতের তরফে নির্বাচন কমিশনকে এসআইআর প্রক্রিয়ায় আধার, ভোটার আইডি (এপিক) এবং রেশন কার্ডকে নথি হিসাবে বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার কমিশনের তরফে শীর্ষ আদালতকে জানানো হয়েছে, ভোটার তালিকায় নাম তোলার ক্ষেত্রে সেগুলি বিবেচনা করা যাবে না। কমিশনের যুক্তি, আধার আদতে একটি পরিচয়পত্র মাত্র, নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। এমনকি, এসআইআর-পর্বে নতুন করে ভোটার তালিকায় নাম তোলার ক্ষেত্রে ভোটার আইডি-ও চূড়ান্ত পরিচয়পত্র হতে পারে না বলে জানিয়েছে কমিশন। একই ভাবে রেশন কার্ডকেও ভোটার তালিকায় নাম তোলার বৈধ নথি হিসাবে ধরছে না কমিশন।
সকলকেই নথি জমা দিতে হবে?
না। সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ককেই ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে না। বিহারে ২০০৩ সালে এসআইআর হয়েছিল। তার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল ভোটার তালিকা। কমিশন জানিয়েছে, বিহারের ক্ষেত্রে ২০০৩ সালে জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের নাম থাকবে। অর্থাৎ, নিবিড় সমীক্ষা করা হচ্ছে তার পর থেকে শেষ দফা পর্যন্ত যাঁদের নাম উঠেছে, সেই ২২ বছরের সময়কাল ধরে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে শেষ বার এসআইআর হয়েছিল ২০০২ সালে। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়া শুরু হলে ২০০২ সালের ওই তালিকাকেই ‘নির্ভুল’ হিসাবে ধরবে কমিশন। যেমন হচ্ছে বিহারের ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন:
কী প্রক্রিয়ায় এসআইআর বা এই সমীক্ষা?
প্রতি বুথে এক জন করে সরকারি আধিকারিক থাকেন (বিএলও)। তাঁর কাছে গিয়ে নথি জমা করতে হয় ভোটারদের। বুথগুলিতে কী নথি জমা পড়ল, তা যাচাই হয় বিধানসভাভিত্তিক। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে এক জন করে সরকারি আধিকারিক ওই কাজ করছেন। তার পর তা জেলা স্তরে যাচাই হচ্ছে। তার পরে তা যাচ্ছে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরে।
কী কী প্রশ্ন উঠছে?
বিহারের এসআইআর নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলছে বিরোধী শিবির। তার মধ্যে অন্যতম সময়। প্রথমত, কেন এক মাসের সময়সীমায় এত বড় কর্মযজ্ঞ করতে হল কমিশনকে? যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন, তাঁরা বাড়ি ফিরে কী ভাবে নথি জমা দেবেন? কেন ভোটের তিন মাস আগেই এসআইআর করতে হল? ভুয়ো ভোটার যদি থেকেই থাকে, তা হলে কি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই ভোটের জোরেই বিজেপি-জোট বিহারে জিতেছিল? কমিশনের তরফে সব প্রশ্নের ধরে ধরে জবাব না-দেওয়া হলেও সার্বিক ভাবে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক নিয়ম মেনেই এসআইআর হচ্ছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কমিশন প্রদত্ত পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, তালিকা থেকে বাদ পড়া ৫৬ লক্ষ ভোটারের মধ্যে সাড়ে ২১ লক্ষ মৃত এবং ৩১ লক্ষ অন্যত্র চলে গিয়েছেন। দেড় লক্ষ এমন নামের সন্ধান মিলেছে, যাঁদের একটির বেশি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটার হিসাবে নাম রয়েছে। অর্থাৎ, ৫৬ লক্ষ সংখ্যাটিকে যে ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, আসলে বিষয়টি তা নয়। কমিশনের আরও বক্তব্য, যখনই এই প্রক্রিয়া হোক, কোনও না কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে তা ভোটের সময়েই হবে। অতীতেও তা-ই হয়েছিল। পাল্টা বিরোধীদের বক্তব্য, অতীতে নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস সময় নিয়ে। ফলে মানুষ নথি গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ বার আচমকা এবং দ্রুততার সঙ্গে তা করা হয়েছে। বিরোধীদের দাবি, এর ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের স্থানান্তরিত তালিকায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
বিতর্কও অনেক
কমিশন যে ১১টি নথি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির শংসাপত্র, জমির দলিল বা বনাঞ্চলের অধিকারের শংসাপত্রে জন্মতারিখের উল্লেখ থাকে না। তা হলে সেই নথি দিয়ে কী ভাবে নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভোট দেওয়ার বয়স হয়েছে কি না? বিহারে এনআরসি বা পারিবারিক রেজিস্টার কার্যকর নেই। তা হলে তা কী ভাবে নথি হিসাবে নির্ধারিত হল? আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবের কথায়, ‘‘এ তো দাবার ঘুঁটি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে বলছে নির্বাচন কমিশন!’’