কে প্রথম দেখেছিলেন তরুণী চিকিৎসকের মৃতদেহ?
আর জি করে তরুণী চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরে ১২ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কলকাতা পুলিশের হাত থেকে তদন্তভার চলে গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রশ্নের জবাব এখনও স্পষ্ট ভাবে মেলেনি বলেই সূত্রের দাবি।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আপাতত এই উত্তর খুঁজতেই কালঘাম ছুটছে তদন্তকারী সংস্থার। প্রথম দিন থেকেই অভিযোগ উঠছিল, তবে কি কারও নাম গোপন করতেই এ সব করা হচ্ছে? সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, সেই প্রশ্ন এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের প্রশ্ন, নাম গোপন করার রহস্য কি ভেদ করতে পারছে না সিবিআই-ও?
কলকাতা পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছিল, চিকিৎসকের দেহ প্রথম দেখা গিয়েছিল, বেলা সাড়ে ৯টা নাগাদ। দাবি, পুলিশের কাছে নাকি খবর পৌঁছয় বেলা ১০টা ১০ মিনিটে। পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছিল, এর পরে টালা থানা থেকে অফিসার গিয়ে ওই হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে থাকা কর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থল অর্থাৎ সেমিনার রুমে যান। এর পরে একে একে ঘটনাস্থলে পৌঁছন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। কিন্তু প্রথম কে মৃতদেহ দেখেছেন, সেই তথ্য তখন পুলিশের কাছেও স্পষ্ট হয়নি বলেই সূত্রের খবর। তদন্তের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্তার দাবি, ‘‘আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, কে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাকে ধরা। কে প্রথম মৃতদেহ দেখলেন, তা নিয়ে তখন স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। তার মধ্যেই সিবিআই-কে তদন্তভার দিয়ে দেওয়া হয়।’’
সে দিন কী ঘটেছিল মৃতদেহ উদ্ধারের পরে?
ওই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত এক চিকিৎসকের দাবি, কিছু একটা হয়েছে বলে বেলা ১১টা নাগাদ খবর রটতে শুরু করে। তত ক্ষণে হাসপাতালের জরুরি বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ জড়ো হতে শুরু করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এর পর আমাদেরই এক সহকর্মীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে বলে খবর পাই। আমরা রাস্তা চিনি বলে ঘুরপথে সেমিনার রুমের কাছে পৌঁছে যেতে অসুবিধা হয়নি। গিয়ে দেখি, সেমিনার রুম-এর দরজায় পুলিশি পাহারা বসেছে। কয়েক মিনিটেই দেখা গেল, সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন হাসপাতালের তৎকালীন সুপার এবং অধ্যক্ষ। তিনি নিজেই সেখানে দাঁড়িয়ে এর পরে দাবি করেন, খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ৮টাতেই তিনি নাকি সেখানে চলে এসেছেন। আরও কয়েক জন স্বাস্থ্যকর্তাও তাঁর সঙ্গে সেমিনার রুম ঘুরে গিয়েছেন বলেও সেখানে দাবি করেন তিনি। এক পুলিশকর্মীর উদ্দেশে তাঁকে বলতে শোনা যায়, প্রশাসনের শীর্ষস্তরে তিনিই নাকি ফোন করে সমস্তটা জানিয়েছেন। এর পরে ধীরে ধীরে ওই জায়গার দখল নেন অধ্যক্ষ ঘনিষ্ঠ পড়ুয়ারা।’’
পুলিশকর্তারা তদন্ত শুরু করেই জানতে চান, মৃতদেহ প্রথম কে দেখল? কিন্তু কেউই তার স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি। এক বার অধ্যক্ষ ঘনিষ্ঠ পড়ুয়াদের মধ্যে থেকে বলা হয়, এক জন নার্স দেখেছেন। কিন্তু তিনি কোথায়? পুলিশ জানতে চাইলে কাউকেই হাজির করানো হয়নি। এক চিকিৎসকের দাবি, ‘‘এর পরে বলা হয়, এক জন আয়া দেখেছেন। তিনি কে? দেখার পরে কী করলেন? উত্তর মেলেনি। কিছুটা বিরক্ত হয়েই পুলিশ এর পরে বলে দেয়, ময়না তদন্তের ব্যবস্থা আগে হোক। তার পরে এটা দেখছি।’’ কিন্তু আর দেখা হয়েছিল কি? উত্তর মিলছে না।
সূত্রের খবর, টানা ৩৬ ঘণ্টা কাজ করার পরে সে দিনই তরুণীর ইউনিট বদল হওয়ার কথা ছিল। সকাল ৮টায় ইউনিট বদল হয় ওই হাসপাতালে। ফলে নতুন ইউনিটে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউ তরুণীর খোঁজ করলেন না কেন? আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরাই দাবি করছেন, ‘‘তরুণী নিজের ইউনিটের সবচেয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। সকাল থেকে তো তাঁকে ইউনিটে আসা রোগীর অবস্থা দেখতে বা রিপোর্ট দেখতে ডাকার কথা। কেউ তাঁর খোঁজ করলেন না?’’ জানা যাচ্ছে, নতুন ইউনিটের সদস্যরা নাকি খোঁজ করেছিলেন দায়িত্বভার বুঝে নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটা বেলা সাড়ে ১০টার পরে। কেন এত দেরিতে সে দিন ইউনিট বদল হয়েছিল? স্পষ্ট উত্তর নেই।
জানা গিয়েছে, মৃতার পরিবারকে ফোন করে এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার জানান, তাঁদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিসের ভিত্তিতে তিনি মৃতার পরিবারকে এই খবর দিলেন? সূত্রের খবর, জেরায় ওই মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার দাবি করেছেন, মৃতদেহ পড়ে রয়েছে বলে খবরটি তিনি পান পালমোনারি মেডিসিন বিভাগের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসারের কাছ থেকে। মৃতা তরুণীর ইউনিট এই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসারের অধীনেই কাজ করছিল। দাবি, এর পরে তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাতে গিয়ে দেখেন, আগে থেকেই কর্তৃপক্ষ সবটা জানেন এবং তাঁকে বিশদে কিছু না জানিয়েই মৃতার পরিবারকে ডেকে নিতে বলা হয় কর্তৃপক্ষের তরফে। নিজের ভুলেই নাকি তিনি আত্মহত্যার কথা বলে ফেলেছেন! এ দিন ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘যা বলার পুলিশকে বলেছি। আর কিছু বলতে চাই না।’’ সিবিআই জানতে চেয়েছে কি...? প্রশ্ন শোনার আগেই ফোন কেটে দেন তিনি।
তবুও সে দিনের ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তুলেছে খোদ সুপ্রিম কোর্টও। শীর্ষ আদালত জানতে চেয়েছে, কেন সকালে মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পরেও তৎকালীন অধ্যক্ষ অভিযোগ দায়ের করলেন সেই রাতে গিয়ে? যে অবস্থায় তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়, সেটা যে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, সেটা বুঝতে এক দল চিকিৎসক এবং পুলিশের কেন এতটা সময় লাগল? আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ইঙ্গিত করছে এক গাফিলতির দিকে। আর বৃহৎ কোনও ষড়যন্ত্রের দিকে!’’