Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
আজ ধর্না সিবিআই দফতরে

আসিফ-রজত আবার কে! সব চরিত্রই কাল্পনিক

ছবির পর্দায় প্রশ্নকর্তা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ডক্টর হাজরা রূপে। বিস্মিত মুকুলকে ভরসা দিতে বলা হয়েছিল ‘হাজার হাজার ডক্টর হাজরা’র স্তোকবাক্য! ‘সোনার কেল্লা’র বালক মুকুল ছিল জাতিস্মর। কখন সে এ জন্মে থাকে, কখন আবার আগের জন্মে ফিরে যায় সে সব নাকি তাল রাখা যেত না। বাস্তবের মুকুলের দল কড়া সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তবু মাথার উপরে মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে আকাশ!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৪
Share: Save:

ছবির পর্দায় প্রশ্নকর্তা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ডক্টর হাজরা রূপে। বিস্মিত মুকুলকে ভরসা দিতে বলা হয়েছিল ‘হাজার হাজার ডক্টর হাজরা’র স্তোকবাক্য!

‘সোনার কেল্লা’র বালক মুকুল ছিল জাতিস্মর। কখন সে এ জন্মে থাকে, কখন আবার আগের জন্মে ফিরে যায় সে সব নাকি তাল রাখা যেত না। বাস্তবের মুকুলের দল কড়া সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তবু মাথার উপরে মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে আকাশ! কে রজত মজুমদার, কে আসিফ খান চিনতে পারছেন না তৃণমূল নেতারা! সিবিআইয়ের ঠেলায় সব গুলিয়ে যাচ্ছে!

ছায়াছবির ‘দুষ্টু লোকে’র দল মজেছিল সোনার কেল্লার কল্পিত গুপ্তধনের স্বপ্নে। বাস্তবের মুকুলের দল বিপাকে সারদা নামক স্বর্ণমৃগের হাতছানিতে! তাই কি এমন স্মৃতিভ্রম? বিরোধীরা যাকে বলছেন, ‘সিলেক্টিভ অ্যামনেসিয়া’! প্রশ্ন তুলছেন, রাজ্যের শিল্পায়ন নিয়ে রতন টাটার সমালোচনাকে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র যদি ‘মতিভ্রম’ বলতে পারেন, বিপদের সময়ে তাঁর দলের এই স্মৃতিভ্রমও কি আসলে মতিভ্রম নয়!

সারদা-কাণ্ড নিয়ে কুণাল ঘোষ, রজত, আসিফদের পালা করে জেরা করছে সিবিআই। কুণাল আগেই জেল-হাজতে। সদ্য গ্রেফতার হয়েছেন রজত। আসিফ সিবিআই-কে সহযোগিতার কথা বলে তৃণমূলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা করেছেন। তাতেই উদ্বেগ বেড়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের। বাঁধনহীন হয়ে তিনি কী না কী বলে বসেন সিবিআই-কে! এখন কী করা? তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁর পরিচয়ই বেমালুম ভুলে গিয়েছেন! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুধবার বলে দিয়েছেন, “আসিফ খান বলে কাউকে চিনি না!”

আসিফ ছিলেন তৃণমূলের উত্তরপ্রদেশের পর্যবেক্ষক। ঠিক যেমন রজত ছিলেন বীরভূম জেলার পর্যবেক্ষক। তৃণমূলে যোগদানের সময় সহ-সভাপতির সম্মানও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। অথচ বুধবার তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে বসেছেন, “উনি (রজতবাবু) যে তৃণমূল করতেন, আমি জানতাম না! এখন জানছি!” তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তৃণমূল ভবনে পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, “রজত তৃণমূলের সদস্য নন। সহযোগী।” দলের একাংশের প্রশ্ন, সদস্য না-হলে রজতবাবু পর্যবেক্ষক হয়েছিলেন কী ভাবে?

রজত-আসিফদের চিনতে না-পারলেও তৃণমূল কিন্তু সিবিআইয়ের ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ চিনতে কোনও ভুল করছে না! তাই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত আজ, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে সল্টলেকে সিবিআই দফতরের সামনে অনির্দিষ্ট কাল ধর্না-অবস্থানে বসবেন তৃণমূলের মহিলা কর্মীরা! মহিলা তৃণমূলের রাজ্য সভানেত্রী এবং রাজ্যের আইন প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “লাগাতার ধর্না চলবে, না রাতে বিরতি নেওয়া হবে, আমরা বিবেচনা করে দেখব।” চন্দ্রিমার ব্যাখ্যা, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজ করছে এবং তদন্তের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সারদা-বিড়ম্বনা সামাল দিতে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে চরম আকার দেওয়া হতে পারে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।

চন্দ্রিমা ধর্নার কথা ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টা আগেই রাজ্যের আর এক মন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সিবিআই রাজনৈতিক দল হলে রাজনৈতিক প্রতিবাদ-আন্দোলন করতে পারতাম। কিন্তু এটা অসম লড়াই হচ্ছে! কারণ, সিবিআই একটা সরকারি সংস্থা।” তবে একই সঙ্গে সিবিআই-কে ‘দানব’ আখ্যা দিয়ে তিনি এ-ও বলেছিলেন, “প্রয়োজনে রাজনীতি দিয়েও মোকাবিলা করতে হবে!”

বস্তুত প্রতি পদক্ষেপেই এখন তৃণমূল নেতৃত্বের বিভ্রান্তি প্রকট! সিবিআইয়ের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ এবং সংবাদমাধ্যমের ‘অপপ্রচারে’র জবাব দিতে নতুন নতুন মুখকে সামনে ঠেলতে হচ্ছে তৃণমূলকে। এবং দলের অন্দরের খবর, সে কাজও সহজে হচ্ছে না! যে তৃণমূলে ক্যামেরার সামনে ছবি তোলার জন্য বড়-মেজ-ছোট নেতাদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, সেই দলেই এখন কেউ সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে চাইছেন না! উপনির্বাচনে ‘কঠিন লড়াই’য়ের দোহাই দিয়ে বেশির ভাগ নেতারা এখন চলে যাচ্ছেন বসিরহাট! পার্থবাবুই যেমন মঙ্গলবার চলে গিয়েছিলেন। আর সুব্রতবাবু অন্য কাজে ‘ব্যস্ত’ ছিলেন! দলনেত্রীর চাপে এ দিন আর সে সব সম্ভব হয়নি। দু’জনেই মুখোমুখি হয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমের। পার্থবাবু আসিফ-মন্তব্য ছাড়া এমন কিছু বলেননি, যা আগে বলেননি। আর সুব্রতবাবু অভিযোগ করেছেন, “সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে। যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা চলছে, তাকে তীব্র ধিক্কার জানাই। এটার নিন্দা করতেই এসেছি।”

তৃণমূল নেতারা যত দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন, তত জালে জড়াচ্ছেন! বিরোধীরা তো বটেই, দলের বিক্ষুব্ধ নেতারাও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলছেন! পার্থবাবুর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আসিফ যেমন পাল্টা বলেছেন, “আমাকে দলে নিযুক্ত করেছিলেন মমতাদি, মুকুলদা। আমি জাতীয় রাজনীতিতে থাকতাম। পার্থদা আমার নেতা নন। সহকর্মী।” আবার সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল লিখিত বিবৃতিতে আবেদন জানিয়েছেন, ‘তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে অনুরোধ, নিজেদের আড়াল করার স্বার্থে কিছু নেতা প্ররোচনা দিয়ে আপনাদের রাস্তায় নামতে বলছেন। আপনাদের ঢাল বানাচ্ছেন! এঁদের প্ররোচনায় পা দেবেন না’!

বিরোধীরা স্বভাবতই এই অবস্থার সুযোগ নিতে তৎপর। তৃণমূল নেত্রীকে ‘কুইন পিন’ আখ্যা দিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যেমন বলেছেন, “তৃণমূল দলে এখন ছুঁচোর কেত্তন চলছে! যে কোনও দিন ভেঙে পড়তে পারে!” সুদীপবাবুর উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “ওঁর পক্ষে তাল রাখা মুশকিল! উনি এ দল-ও দল করেন তো! কখনও কংগ্রেস, কখনও তৃণমূলে থাকেন। তবে কুখ্যাত পুলিশ অফিসার রজত মজুমদারকে চেনেন না?” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার পরে দাবি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে সারদার সঙ্গে তাঁর দলের সম্পর্ক স্পষ্ট করুন।

আর স্মৃতিভ্রমের প্রসঙ্গ তুলে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের খোঁচা, “উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দলে দলে লোকের হাতে তৃণমূলের ঝান্ডা ধরাচ্ছিলেন মুকুল রায়। আসিফ, রজতেরা সব তাঁর লোক! অন্যেরা হয়তো তাই চিনতে পারছেন না!” তিনি যোগ করেন, “মুকুল কার লোক, প্রশ্ন করলে কী হবে কে জানে!”

কে কার লোক, সব গুলিয়ে যাচ্ছে! সব চরিত্রই যেন কাল্পনিক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE