নিজের গ্রামে ফিরতে না পেরে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুক বোলপুরের পার্টি অফিসে আশ্রয় নিয়েছিল সে। বুধবার রাতে সেখান থেকেই নিখোঁজ গিয়েছে ‘তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী’ হিসাবে পরিচিত, মঙ্গলকোটের আজাদ মুন্সি। এই ঘটনাকে ঘিরে ধোঁয়াশা রয়েছে।
২০১০ সালে নানুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাস হত্যা-সহ বেশ কয়েকটি খুন, খুনের চেষ্টা, তোলাবাজি ও পুলিশের উপরে হামলা মিলিয়ে কম করে ২৮টি অভিযোগ রয়েছে বছর উনত্রিশের আজাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, পুলিশ কখনওই তার টিকি ছুঁতে পারেনি। অথচ তৃণমূল সূত্রেই খবর, মাসখানেক ধরে বোলপুর থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তৃণমূলের পার্টি অফিসে আজাদ থাকছিল। যে অফিসে বসে বীরভূম জেলায় দল পরিচালনা করেন অনুব্রত মণ্ডল। এক মাস ধরে শাসকদলের পার্টি অফিসে থাকার জন্যই কি পুলিশ আজাদকে ধরেনি? বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “আমি কোনও মন্তব্য করব না।”
দলের একাংশের দাবি, বর্ধমানের মঙ্গলকোট (যে এলাকায় আজাদ এক সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছে) ছাড়ার পরে অনেক দিন নানুরে ছিল আজাদ। মাসখানেক হল বোলপুরে ছিল। সেই পার্টি অফিস থেকেই আজাদের আচমকা বেপাত্তা হয়ে যাওয়াটা তৃণমূলের অনেকের কাছেই ‘রহস্যজনক’ ঠেকছে। যেমন ঠেকছে আজাদের ভাই অঞ্জন মুন্সির কাছেও। শুক্রবার দুপুরেই বোলপুর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন অঞ্জন। মঙ্গলকোট গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য অঞ্জন বলেন, “বুধবার সন্ধ্যায় কথা হয়েছিল। তার পর থেকে আর খোঁজ পাচ্ছি না। নানা জায়গা থেকে নানা খবর আসছে।”
পার্টি অফিসে আজাদ থাকত বলে মানতে চাননি অনুব্রত। তাঁর বক্তব্য, “আজাদ দু-তিন বার আমার কাছে এসেছে। নিয়মিত কোনও যোগাযোগ আমার সঙ্গে ছিল না। আমিও শুনেছি, ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে যায়নি তো!” তবে, বিষয়টি এত সহজ বলে মানতে নারাজ আজাদ-ঘনিষ্ঠ নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখ, যিনি জেলা রাজনীতিতে অনুব্রতর বিরোধী হিসাবেই পরিচিত। এ দিন কাজল বলেন, “আজাদকে খুঁজে না পাওয়ার পিছনে একটি রহস্য কাজ করছে। বেশ কিছু নাম শোনা যাচ্ছে। পুলিশ তাঁদের জেরা করলেই সব জানা যাবে বলে আমার ধারণা।”
কে এই আজাদ? মঙ্গলকোটের কুনুর নদী ঘেঁষা আড়াল গ্রামে এক প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের বড় ছেলে আজাদ। অল্প বয়সে ছোটখাটো দুষ্কর্ম করে সে মঙ্গলকোটের তৎকালীন দাপুটে সিপিএম নেতা ডাবলু আনসারির নজরে পড়ে। সাত-আট বছর ডাবলুর দলে কাজ করে আজাদ। পুলিশ সূত্রের খবর, ২০০৬-এ পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবেও কাজ করেছে সে। তার জন্যই পুলিশ তখন মঙ্গলকোটে অনেক ঘটনার কিনারা করতে পেরেছে। দু’হাতেই বন্দুক চালানোর দক্ষতা রয়েছে আজাদের। ওই কর্তার কথায়, “কিন্তু ২০০৮-এ পঞ্চায়েত ভোটে আজাদের বাবা ও কাকা তৃণমূলের হয়ে মনোনয়ন জমা দিতেই হিসেব পাল্টে যায়। ডাবলুর দলবলের বিরুদ্ধে আজাদের বাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ ওঠে। ভোটের পরে আজাদের খুড়তুতো ভাই সাইফুলকে বাস থেকে নামিয়ে গুলি করে খুন করা হয়। আজাদকেও মারার চেষ্টা হয়। কিন্তু, ও বেঁচে যায়।”
স্থানীয় সূত্রের খবর, তার পরেই মঙ্গলকোট ছেড়ে কাজল শেখের আশ্রয়ে চলে যায় আজাদ। পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, মঙ্গলকোট ও নানুরে অজয় নদ লাগোয়া এলাকায় ইটভাটা মালিকদের কাছে তোলা আদায় করত আজাদ। তার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে বর্ধমানের ইটভাটা মালিকদের সংগঠন চিঠি পাঠানোর পরে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে আজাদকে ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবু পুলিশ তাকে ধরেনি। নানুরে অজয়ের চরে দল নিয়ে থাকত আজাদ। মঙ্গলকোটে কুনুর নদীর সেতুতে পুলিশের গাড়ি দেখতে পেলেই আজাদের বাহিনী পালাত। পরে ফিরে এসে চরে বোমাবাজি করত।
এক তৃণমূল নেতার দাবি, কাজল শেখের সঙ্গে আজাদের হৃদ্যতা অনেক দিনের। কিন্তু, অনুব্রত-গোষ্ঠীর বাধায় আজাদ নিজের গ্রামে ঢুকতে পারছিল না। ভাই অঞ্জনও গ্রামছাড়া। ওই নেতা বলেন, “এ দিকে বৃদ্ধ বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে খবর ছিল আজাদের কাছে। গ্রামে ঢোকার তাগিদেই বোলপুরে অনুব্রত মণ্ডলের অফিসে আশ্রয় নিয়েছিল আজাদ। ভেবেছিল, মঙ্গলকোটের নেতাদের সঙ্গে বোঝাপাড়া করে গ্রামে ফিরবে।”
অঞ্জন জানান, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ আজাদ রুটি কিনে তৃণমূল অফিসে যায়। সেখানে তাঁর সঙ্গে গল্প করে। তার পরে ফোন আসতেই হনহন করে বেরিয়ে যায় আজাদ। খোঁজ মিলছে না তার পর থেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy