Advertisement
E-Paper

বাংলাদেশে ফেরার দর বাড়াল ‘লাইনম্যান’

বিস্ফোরণ বদলে দিল পারাপারের দর। এতদিন চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে মাথাপিছু লাগত প্রায় ৩ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ থেকে এ দেশে ঢুকতে লাগত প্রায় ৪ হাজার টাকা। কিন্তু ‘লাইনম্যান’-রা (যারা চোরাপথে মানুষ পারাপার করে) জানাচ্ছে, খাগড়াগড় কাণ্ডের পর নিয়মটা উল্টে গিয়েছে। এখন এ দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে প্রায় এক হাজার টাকা বেশি লাগছে। কোথাও আরও বেশি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২০

বিস্ফোরণ বদলে দিল পারাপারের দর।

এতদিন চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে মাথাপিছু লাগত প্রায় ৩ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ থেকে এ দেশে ঢুকতে লাগত প্রায় ৪ হাজার টাকা। কিন্তু ‘লাইনম্যান’-রা (যারা চোরাপথে মানুষ পারাপার করে) জানাচ্ছে, খাগড়াগড় কাণ্ডের পর নিয়মটা উল্টে গিয়েছে। এখন এ দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে প্রায় এক হাজার টাকা বেশি লাগছে। কোথাও আরও বেশি।

আসা-যাওয়ার দরে ফারাক কেন? লাইনম্যানরা জানাচ্ছে, ভারত থেকে বাংলাদেশে লোকে বসবাস করতে যায় না, যায় বেড়াতে। তাগিদ কম বলে দরও কম। কিন্তু ‘অনুপ্রবেশ’, অর্থাৎ পাকাপাকি থাকার জন্য ভারতে থাকতে বহু লোক আসতেন বাংলাদেশ থেকে। তাই ভারতে ঢোকার দামটা ছিল বেশি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেই টাকা ভাগ হয়ে যেত দু’দেশের সীমান্তরক্ষী থেকে শুরু করে পুলিশ, দালাল, লাইন ম্যানদের মধ্যে।

হঠাৎ হিসেব উল্টে গেল কেন?

লাইনম্যানদেরই কথায়, ভারত থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার সংখ্যাটা হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছে। সেই যাওয়াটা নিছক ঘুরতে নয়, বেশ কিছুদিনের জন্য পাকাপাকি ভাবে বাংলাদেশে বসবাসের উদ্দেশ্যে। পরিস্থিতি ঠিক হলে তবেই ফিরে আসবেন তাঁরা। এই চিত্র গোটা রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকাতেই। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মূর্শিদাবাদ, মালদহ থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের সীমান্ত এলাকাতেও দেখা যাচ্ছে এই চিত্র। বাংলাদেশ থেকে এ দেশে ঢোকার সংখ্যাটা কমেছে। আবার বাড়তি সতর্কতা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার ক্ষেত্রেও জারি হয়েছে কড়াকড়ি। পেট্রাপোল শুল্ক দফতরের ক্লিয়ারিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “তাই এই বাড়তি ঝক্কি পেরিয়ে বাংলাদেশে যাঁরা ফিরে যাচ্ছেন তাঁদের জন্য সুযোগ বুঝে দর বাড়িয়ে দিয়েছে চোরাপথের সিন্ডিকেটগুলিও।” যেন এটা পুনঃপ্রবেশ কিংবা প্রত্যাবর্তন।

কিন্তু কেন এই উল্টোপুরাণ?

আসলে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কান্ডের পরে প্রশাসন সূত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে কিংবা যাঁরা ভাড়াটিয়া হিসেবে রয়েছেন, তাঁদের ভোটার কার্ড, জন্ম প্রমাণপত্র, প্যান কার্ড(আবশ্যিক নয়) এবং আগে যেখানে ভাড়া ছিলেন তার নথি নিয়ে দেখা করতে হবে সংশ্লিষ্ট থানায়। সেখান থেকে একটি ফরম নিতে হবে। তারপর সেটা ভর্তি করে তারসঙ্গে নথিপত্রের জেরক্স ফের জমা দিতে হবে থানায়। এর অন্যথা হলে বিপদে পড়বেন বাড়িওয়ালা স্বয়ং। বিপত্তির শুরু এখানেই। পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে খবর, এই প্রচারের পরপরই ভাড়াটিয়ারা সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে পরিচয়পত্র জমা দিচ্ছেন। যাদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, বাড়িওয়ালারাই চাপ দিয়ে সেইসব ভাড়াটিয়াদের তুলে দিচ্ছেন। বারাসত পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তসলিমা খাতুন বলেন, “আমার ওয়ার্ডের মেঠোপাড়া এলাকা পুরো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। শ-খানেক বাংলাদেশি পরিবার ভাড়া ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছে।” ওই এলাকারই বাসিন্দা ফজরুল হক বলেন, “কোনও বাড়িতে তিন-চারটি পরিবারও থাকত। পরিচয়পত্র না থাকায় ক’দিনের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।”

বারাসত পুর এলাকার মতোই, দত্তপুকুর, শাসন থানা এলাকার পঞ্চায়েতগুলোতেও ছবিটা এক। কদম্বগাছি পূর্ব-ইছাপুর কলোনির বাসিন্দা সফিকুল, গফফর, মহসিনদের ভাড়াটিয়ারা গত ক’দিনের মধ্যে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছে। হেমন্ত বসু কলোনির বাসিন্দা পরেশ ঘোষ জানালেন, তাঁর দুই ভাড়াটের একজন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি বলে উঠে গিয়েছেন।

একই অবস্থা সীমান্ত-লাগোয়া বনগাঁ-বসিরহাটেও। দেগঙ্গা থানার ভাসিলা কলোনি, গোঁসাইপুর, কয়াডাঙা, লেবুতলা, পদ্মপুকুর এলাকা থেকেও বহু মানুষ রাতারাতি পাততাড়ি গুটিয়েছেন। দেগঙ্গা ব্লকের চাঁপাতলার প্রাক্তন প্রধান, বর্তমান তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য মহম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “এই বাংলাদেশিরা আমাদের কাছে এসে বলছে, ‘আমাদের বাঁচান।’ আরে বাঁচাব কী? এ সব জায়গাতেই তো কত দুষ্কৃতী গা ঢাকা দিয়ে থেকেছে।” নদিয়া জেলার শিকারপুরে ভাড়া থাকত বাংলাদেশের বাসিন্দা আমিরুল সেখ। খাগড়াগড় কাণ্ডের পর থেকে সে বেপাত্তা।

নদিয়ার হাটখোলা, গেদে, রামনগর, মহখোলা, করিমপুর এলাকায় চোরাপথ দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার সংখ্যা যেমন বেড়ে গিয়েছে খাগড়াগড় কাণ্ডের পর, তেমন ভাবেই মুশির্দাবাদের রানিনগর, জলঙ্গি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে যাওয়ার ঢল নেমেছে। পদ্মার জল কম থাকায় চোরাপথে যাতায়াতে বাড়তি সুবিধাও হয়েছে।

আবার মালদহের হবিবপুর, কালিয়াচক দিয়ে চোরাপথে বাংলাদেশ যেতে দ্বিগুণ টাকা দিতে হচ্ছে লাইনম্যানদের। এ দেশে ঢোকার খরচ কমে গিয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে ওপারে যাওয়ার ‘ভাড়া’ বেড়ে গিয়েছে পাঁচ গুণ। জলপাইগুড়ির বেরুবাড়ি এলাকাতেও বাংলাদেশে যাওয়ার খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। কোচবিহার জেলার চ্যাংরাবান্ধা, দিনহাটার মতো এলাকাতেও চোরাপথে বাংলাদেশ থেকে ঢোকার চেয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার খরচ এক মাসে তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে।

উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে গোটা জেলায় ধরা পড়ে ১১৯ জন বাংলাদেশি, অক্টোবর মাসে ২৮০ জন। কিন্তু কড়াকড়ি সবই হল খাগড়াগড় কাণ্ডের পর। এলাকার মানুষের ক্ষোভ, এই সতকর্তা আগে ছিল না। সীমান্ত এলাকার রেলবস্তি, কলোনিগুলি থেকে গোয়েন্দা ও পুলিশের হাতে গত কয়েক বছরে ধরা পড়েছে বেশ কিছু জঙ্গি, দাগী সমাজবিরোধী। তখনই সতর্ক হলে কি এড়ানো যেত না খাগড়াগড়ের মতো বিস্ফোরণ?

এ ব্যাপারে উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “মাইকে প্রচার করে ভাড়াটিয়াদের থানার নথি জমা দেওয়ার নির্দেশ খাগড়াগড় কাণ্ডের পরে করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এ ব্যাপারে আগেও পদযাত্রা করে, পোস্টার সেঁটে বাড়িওয়াদের সতর্ক করা হয়েছে।”

আমেরিকায় এত সতকর্তামূলক ব্যবস্থার পরেও ‘টুইন টাওয়ার’-এর উপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিমের বক্তব্য, “সব সময়েই নির্দিষ্ট কিছু সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে কোথাও কোনও বড় ঘটনা ঘটলে তখন সেই ব্যবস্থা আরও বেড়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক।”

lineman khagragarh blast bangladesh border arunakhya bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy