আনন্দ ও উদ্বেগ। বাড়ি ফিরে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আবু বক্কর মণ্ডল ।
বাড়ি ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন নদিয়ার বড় আন্দুলিয়ার আবুু বক্কর মণ্ডল। এক চিলতে উঠোনে ভেঙে পড়েছে গোটা গ্রাম। দূর থেকে বাবাকে দেখতে পেয়ে ছুটে কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বছর দশেকের মূক ও বধির বড় ছেলে। ব্যাগপত্তর মাটিতে রেখে কোলে তুলতে হল ছোটটাকেও। পড়শিরা ছেঁকে ধরেছে, “এই আবু, কী হয়েছিল বল তো।” আপ্লুত আবু খিদে-ক্লান্তি ভুলে দাওয়ায় বসেই শুরু করেন ইরাক-কথা। দিল্লি হয়ে মঙ্গলবার মাঝরাতে বাংলার ২৫ জন শ্রমিক কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছন। বুধবার বাড়ি ফিরেছেন আবু-সহ নদিয়ার আরও চার জন।
চাপড়ার এক যুবকের সূত্রে মার্বেল শিল্পী আবুর যোগাযোগ হয় মুম্বইয়ের এক সংস্থার সঙ্গে। পাঁচ মাস আগে সেই সংস্থার মাধ্যমে আবু গিয়েছিলেন ইরাকে। মাসে ৫০০ ডলার বেতনের চুক্তিতে। ইরাকের বসরায় পৌঁছতে প্রথমে কেড়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট। আবু বলছেন, “গত পাঁচ মাসে ওরা একটা পয়সাও বেতন দেয়নি। একটা ঘরে ২৫জনকে থাকতে হত। ঠিকমতো খেতেও দিত না।”
মাস তিনেক আগে থেকে গোলমাল শুরু হয়। লাগাতার বোমা ও গুলির শব্দে তাঁরা চমকে উঠতেন। মোবাইল না থাকায় বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। আবুর কথায়, “বুঝতে পারছিলাম না আদৌ বেঁচে ফিরতে পারব কি না। শেষ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের একটি ছেলে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করে। তাদের উদ্যোগেই ফিরতে পেরেছি।”
খোকন সিকদারের কোনও খবর না পেয়ে দুশ্চিন্তায় স্ত্রী ও মেয়ে।
প্রায় একই অভিজ্ঞতা প্রশান্ত মণ্ডলের। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের কাঁচদহ গ্রামে বাড়িতে বসে মঙ্গলবারও তাঁর কানে বাজছে গুলি-বোমার আওয়াজ। রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাওয়া প্রশান্তবাবুঁর কথায়, “সারাদিন শুধু গুলি-বোমা, যুদ্ধ বিমানের ভয়ঙ্কর শব্দ।” প্রায় দু’বছর আগে একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ইরাকের বাছড়ায় যান, চুক্তি ছিল মাসে ৪৫০ ডলার মিলবে। তাঁর অভিযোগ, “ওরা হাতে দিত মাত্র ৩৬০ ডলার। তাও আবার শেষ আট মাসে কানাকড়িও পাইনি।” একটি সরকারি ভবনে বোমা পড়ে জখম হন তাঁর এক সঙ্গী। প্রশান্তবাবু বলেন, “ঘটনার পরে আমাদের আতঙ্ক আরও বাড়ে।” শেষ পর্যন্ত ইরাক সরকার তাঁদের উদ্ধার করে দেশে পাঠায়।
আবু বক্কর, প্রশান্ত মণ্ডলের বাড়িতে উদ্বেগ কাটলেও, এখনও আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন নদিয়ার চাপড়ার দীপালি টিকাদার। ইরাকের মসুলে থাকা স্বামী সমর টিকাদারের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল দিন কুড়ি আগে। দিন পাঁচেক আগে সমরবাবুর মোবাইলে ফোন করতে একজন আরবি ভাষায় কথা বলে। তার মানে বুঝতে পারেননি চাপড়া সীমান্তের মহখোলা গ্রামের দীপালি। পরে ওমানে থাকা আরবি-জানা এক আত্মীয়কে দিয়ে স্বামীর মোবাইলে ফোন করান দীপালিদেবী। তাঁর থেকে তিনি শুধু এটুকুই জানতে পারেন যে, তাঁর স্বামী ওখানে নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, দীপালি জানেন না।
স্বামীর ফোনের অপেক্ষায় আছেন তেহট্টের ইলসামারি সীমান্তের নমিতা সিকদারও। স্বামী খোকন সিকদার সমরবাবুর সংস্থাতেই কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়েছেন মসুলে। ফোনে খোকনবাবুর সঙ্গে নমিতার শেষ কথা হয় দিন কুড়ি আগে। তবে ৪৬ জন ভারতীয় নার্স ও ২৫ জন বাঙালি ফেরার পর আশায় বুক বেঁধেছেন ওঁরা। বুধবার বড় আন্দুলিয়ার আবু বক্কর মণ্ডলের ফোন নম্বর জোগাড় করে তাঁকে ফোন করেন নমিতাদেবী। জানতে চান, “বসরা থেকে মসুল কত দূর? আপনাদেরও ফোন কি কেড়ে নিয়েছিল?” অন্য প্রান্তের কথা শুনতে শুনতে বদলে যাচ্ছিল নমিতাদেবীর মুখের অভিব্যক্তি। ফোনটা রেখে তিনি বললেন, “ইনি তো বললেন, ভয়ের কিছু নেই। দেখা যাক।”
দীপালিদেবী ও নমিতাদেবী জেলাশাসকের কাছে স্বামীদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য লিখিত আবেদনও করেছেন। নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক উৎপল ভদ্র বলেন, “ইরাকে আটকে আছেন এমন ১৪টি পরিবার লিখিত আবেদন করেছে। আমরা স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।”
ইরাকে যেতে বিস্তর ধার-দেনা করতে হয়েছিল আবু বক্করকে। এই ক’মাসে কোনও রোজগার হয়নি। স্ত্রী আশানুর বিবি তবু বললেন, “খেতে পাই না পাই, ওঁকে আর কোথাও যেতে দেব না।”
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য ও কল্লোল প্রামাণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy