গন্তব্য অধরাই। মাখড়ার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার আগে ব্রাহ্মণডিহির কাছেই রবিবার তথাগত রায়দের আটকে দিল পুলিশ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
মাখড়া, চৌমণ্ডলপুরের বাসিন্দাদের ১৪৪ ধারা জারি করা নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। তাঁদের দাবি, বহিরাগতেরা হামলা করার সময়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিন্তু এখন যখন সাহায্য করতে কেউ আসছেন, ১৪৪ ধারার নাম করে তাঁদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। রবিবারও যেমন আটকানো হল তথাগত রায়ের নেতৃত্বে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসা বিজেপি-র প্রতিনিধি দলকে।
সম্প্রতি কাজে যাবেন বলে গ্রাম থেকে বেরোতেই পুলিশ পাকড়াও করেছিল সেচ দফতরের ময়ূরাক্ষী ডিভিশনের এক কর্মীকে। তিন ঘণ্টারও বেশি সময় তাঁকে পাড়ুই থানায় বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। এই হয়রানির পরে সে দিন দফতরের কর্তাদের মধ্যস্থতায় ছাড়া পান মাখড়া গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল হক। সিরাজুল একা নন। চৌমণ্ডলপুর ও মাখড়ায় গত ন’দিন ধরে ১৪৪ ধারা জারি থাকায় এমনই দুর্ভোগে পড়ছেন এলাকার অনেক বাসিন্দাই। বাড়ি থেকে বেরোলেই কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন সেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁদের। ফলে ১০০ দিনের কাজও একরকম বন্ধ। ধান পাকলেও ফসল কাটতে যাওয়ার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না অনেকে। পোকার প্রকোপ দেখা দিলেও মাঠে গিয়ে কীটনাশক দেওয়ার উপায় নেই।
এর মধ্যেই ১৪৪ ধারার যুক্তি দেখিয়েই গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হল না তথাগতবাবুর নেতৃত্বে বিজেপি-র প্রতিনিধিদের। এ দিনই ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযোগে মাখড়া গ্রাম থেকে পুলিশ সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়কে গ্রেফতারও করে। এলাকার বাসিন্দা শেখ জালেনুর, নুরনেহার বিবিদের ক্ষোভ, “পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের উপরে হামলা হতে দেখেছিল। তখন তারা বহিরাগত দুষ্কৃতীদের গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয়নি। আর এখন যাঁরা আমাদের পাশে দাঁড়াতে চান, তাঁদের আইনের অজুহাত দেখিয়ে গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছে না।” তাঁদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই পুলিশ-প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে এলাকায় একপ্রকার ‘অচলাবস্থা’ তৈরি করে রেখেছে।
এই ‘অচলাবস্থা’র মধ্যে স্বাভাবিক ছন্দটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে মাখড়া, চৌমণ্ডলপুর। অথচ সামনেই মহরম। অনেকে আগেই আতঙ্কিত হয়ে গ্রাম ছেড়েছেন। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জীবনেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। গ্রামের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারছেন না দিনমজুরেরাও। গ্রামের মুদিখানাও বন্ধ। কিন্তু জিনিসপত্র কিনতে বাইরেও যাওয়া যাচ্ছে না। জরুরি কাজের যুক্তি দেখিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই পুলিশের ব্যারিকেড ডিঙোনো যাচ্ছে।
মাখড়া আর চৌমণ্ডলপুরে প্রাথমিক স্কুল খোলা থাকলেও ঘটনার পর থেকে সেখানে পড়ুয়া যায়নি। মাখড়া থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে থাকা এলাকার একমাত্র হাইস্কুল হাঁসড়ারও একই হাল। বন্ধ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিও। মাখড়া প্রাথমিক স্কুলের এক ছাত্র বলে, “আমাদের স্কুলেই তো পুলিশ ক্যাম্প। কী করে ক্লাস হবে!”
গ্রামের স্বাস্থ্য পরিষেবা আশাকর্মীদের উপরে অনেকটা নির্ভর করে। এমনই এক কর্মী বলেন, “অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ ওই দুই গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছে। কিন্তু প্রসূতি মায়েরা কিংবা শিশু কারও দেখাই মিলছে না।” স্থানীয় বাসিন্দা শাকিলা বিবি, কারিবা বিবি, আজিজা বিবি, তানিয়া বিবিরা তাই চান, ১৪৪ ধারা উঠে যাক। শেখ সাদেক, শেখ আসমত আলিদের আর্জি, “প্রশাসন ১৪৪ ধারা তুলে নিক। না হলে এ বার আমাদের পেটে লাথি পড়বে।”
এই নিয়ে জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কোনও কর্তাই মুখ খুলতে নারাজ। জেলাশাসক আগের দিনই জানিয়ে দিয়েছেন, “এটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।”
ঘটনার ন’দিন পরে এদিনই প্রথম প্রশাসনের কর্তাদের কারও পা পড়েছে চৌমণ্ডলপুর ও মাখড়ায়। এ দিন সকালে বোলপুরের মহকুমাশাসকের নেতৃত্বে প্রথমে মাকড়ায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছয়। পরে ত্রাণ যায় চৌমণ্ডলপুরেও। এত দিন পরে প্রশাসনের কর্তারা ত্রাণ নিয়ে আসায় বাসিন্দাদের ক্ষোভ আরও বাড়ে। কেউ কেউ ভেবে বসেন, তৃণমূলের বিধায়কেরা ত্রাণ নিয়ে এসেছেন। তাই অনেকেই প্রথমে ত্রাণ নিতে অস্বীকার করেন। ক্ষুব্ধ আনারুল শেখ, শেখ জিয়লরা বলছেন, “এত দিন ওঁরা কী করছিলেন? আজ হঠাৎ করে আমাদের কথা মনে পড়ল?” পরে গ্রামে পৌঁছন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী, আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্তা, ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ)-এর দায়িত্বে থাকা বিশাল গর্গ। তাঁরা পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে বাসিন্দাদের বোঝান। তার পরেই সাড়া মেলে। মাখড়া-কাণ্ডে নিহত দুই বাসিন্দা শেখ তৌসিফ আলি এবং মোজাম্মেল শেখের পরিবারের হাতে জেলাশাসক রাজ্য প্রশাসনের দেওয়া ক্ষতিপূরণের দু’ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন।
দুপুরে ত্রাণ নিয়ে চৌমণ্ডলপুর ও মাখড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেন বিজেপি নেতা তথাগতবাবু এবং সুভাষ সরকার। কিন্তু প্রায় পাঁচশো জনের দলকে মাখড়ার ৫ কিমি আগে ব্রাহ্মণডিহির কাছে ব্যারিকেড গড়ে আটকায় পুলিশ। তথাগতবাবু জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়কে জানান, ত্রাণ নিয়ে তাঁরা মাত্র তিন জন গ্রামে ঢুকতে চান। আনন্দবাবু অবশ্য তথাগতবাবুদের বলেন, “আমাদের আশঙ্কা আপনারা ঢুকলে আইনের অবনতি হবে।” তিনি তথাগতবাবুরদের অনুরোধ করেন ফিরে যেতে। আইন ভাঙলে তাঁদের ধরতে বাধ্য হবেন বলেও জানান আনন্দবাবু। পুলিশ কর্তার ওই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ তথাগতবাবু তখন বলেন, “এখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে আসিনি। গ্রামের মানুষ দু’মুঠো খেতে পাচ্ছেন না। জল পাচ্ছেন না। ওদের জন্যই ত্রাণ দিতে এসেছি মাত্র।” আনন্দবাবু প্রতিনিধি দলকে জানান, প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। তথাগতবাবুরা চাইলে অন্যত্র শিবির করে ত্রাণ দিতে পারে। কিন্তু তাঁদের গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পৌনে তিনটে নাগাদ ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তথাগতবাবুরা। যাওয়ার আগে পুলিশ কর্তাদের উদ্দেশে তথাগতবাবুর অভিযোগ, “আপনারা আইন ভাঙছেন। তৃণমূলকে আনুগত্য দেখাচ্ছেন। অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশে চলছেন। তাই গ্রামে যেতে দিলেন না।”
সকাল সাড়ে ১০টায় মাখড়ায় যান সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির জেলা সম্পাদক শৈলেন মিশ্র। তখন গ্রামে ত্রাণের কাজ চলছিল। তাঁরা তৌসিফের বাড়িতে গিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেন। পরে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযোগে বোলানদেবীদের ধরে পাড়ুই থানায় নিয়ে যায়। এক ঘণ্টা পরে ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া হয়। পরে বোলানদেবী বলেন, “আমরা দু’জন মাত্র পরিবারটির দুর্দশার কথা জানতে এসেছিলাম। তাতে কী ভাবে আইন ভাঙা হল বুঝতে পারছি না।” তাঁর ক্ষোভ, “নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ও একই জিনিস হতে দেখেছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy