E-Paper

দেশে ফিরছেন ‘আয়নাঘর’ থেকে বেঁচে ফেরা পিয়াস

পিয়াস জঙ্গি নন। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না কোনও দিন, আজও নেই। খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন একটি গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে পিয়াস ছিলেন সাধারণ এক জন বিএনপি কর্মী।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৪ ০৯:২৭
পিয়াস হাওলাদার।

পিয়াস হাওলাদার। —ফাইল চিত্র।

পিয়াস হাওলাদার দেশে ফিরবেন। বাংলাদেশে ছাত্র অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পরে বছর তিরিশের পিয়াস এখন উচ্ছ্বাসে ফুটছেন। দিন গুনছেন কুয়েত থেকে দেশে ফেরার।

পিয়াস জঙ্গি নন। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না কোনও দিন, আজও নেই। খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন একটি গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে পিয়াস ছিলেন সাধারণ এক জন বিএনপি কর্মী। শহরে পড়াশোনা করতে এসে বিএনপির শাখা সংগঠন ছাত্র দলের কর্মী হয়ে যান। ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে বিরোধী দল করা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশের কাছে ভয়ানক অপরাধ। ২০১০-এ এক বার ঢাকার রাস্তা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। পিয়াস তখন দলের কর্মসূচির হ্যান্ডবিল বিলোচ্ছিলেন। অজ্ঞাত এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে, আজ যার পরিচিতি ‘আয়নাঘর’ হিসাবে। সেখানে মাঝে মাঝে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করত পুলিশ, অভিযোগ করেছেন পিয়াস। পরে এক মাঝারি সারির পুলিশ কর্তার দাবি মেনে ‘মোটা টাকা ঘুষের বিনিময়ে’ জামিনে মুক্তি মেলে।

তার পরে উদ্বিগ্ন স্বজনদের পরামর্শে ঢাকা থেকে খুলনা আসেন পিয়াস। ২০১১-য় খুলনা থেকে পুলিশ আবার তুলে নিয়ে যায় পিয়াসকে। তাঁর দাবি, “দেশের সব বড় শহরে এমন ‘আয়নাঘর’ আছে। আমাকে এ বার আটক করা হয় খুলনার আয়নাঘরে। সেটা কোথায় আমার কোনও ধারণা ছিল না, আজও নেই।” তবে খুলনার ‘আয়নাঘর’-এ যে অনেককে রাখা হয়েছিল, তাদের কান্না ও চিৎকারে টের পেতেন পিয়াস। নিয়মিত নির্যাতন করা হত তাদের। পিয়াসের অভিযোগ, “যখন ইচ্ছা হত আমাকে ঘর থেকে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হত। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যেতাম। জ্ঞান ফিরলে দেখতাম পুরনো ঘরে পড়ে আছি। বাড়ির লোকেরা হন্যে হয়ে খুঁজত। হদিশ পেত না।”

এর পরে এক পুলিশ কর্তা হঠাৎ ‘সদাশয়’ হয়ে উঠে পিয়াসের বাড়িতে খবর পাঠান। তাঁকে আদালতে তোলা হলে জামিনও পেয়ে যান। পুলিশ কর্তার মুখোশ এ বার খুলে যায়। বাড়ির লোককে তিনি জানান, আর তো গুম করা হবে না, এ বার ‘এনকাউন্টার’। তার চেয়ে তাঁকে মোটা টাকা দিলে পিয়াসকে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। পিয়াসের কথায়, “ঢাকা-খুলনার বাইরে কোথাও যাইনি, আমাকে বসিরহাটের কাছে সীমান্ত পার করে দেওয়া হল। কোনও কাগজপত্র নেই, চেনা কেউ নেই।” ছোটখাটো কাজ করে আর ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়ে থেকে এক সময়ে টাকার বিনিময়ে ভারতীয় কিছু পরিচয়পত্রও করিয়ে নেন পিয়াস। বেঙ্গালুরু ও দিল্লিতে কাজ করে কয়েক মাস করে কাটান। কিন্তু পেট ভরে না, সঙ্গে ধরা পড়ার আতঙ্ক।

বাড়ির লোক ফের সেই প্রভাবশালী পুলিশ কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আরও মোটা টাকার বিনিময়ে পিয়াসের বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়ে তাঁকে আরবের কোনও দেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেন তিনি। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে অনেকটা জমিজমা বিক্রি করে বিপুল টাকা সেই পুলিশ কর্তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিএনপি না-করলে ‘এনকাউন্টার’ করা হবে না আশ্বাস পেয়ে দেশে ফেরেন পিয়াস। কয়েক মাস পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে অবশেষে এখন কুয়েতে।

কুয়েতে কেমন আছেন পিয়াস? তাঁর জবাব— “ক্রীতদাসের মতো। প্রতি ভোটের আগে আশায় থাকি, সরকার কি এ বার বদলাবে? ২০১৪-র ভোট গেল, ২০১৯, ২০২৪-ও গেল। ভাবতাম, আরবের শেখদের মতোই কি বাংলাদেশে শেখ পরিবারের চিরস্থায়ী শাসন কায়েম হল? আমার কি দেশে ফেরা হবেই না?”

শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার দিনেই বার্তা পাঠিয়েছিলাম— ‘পিয়াস, দেশে ফেরার সময় হয়েছে।’ ছোট্ট জবাব ছিল, ‘জ্বি দাদা।’ তার পরেই টেলিফোন। উচ্ছ্বাস ধরছে না যেন। কে বলবে, মাস কয়েক আগে নির্বাচনের ঠিক আগে বার্তা পাঠিয়েছিলেন পিয়াস, ‘আমি আর এই বাংলাদেশে থাকতে চাই না! অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্ব পেতে সাহায্য করবে দাদা?’ শুক্রবার ফোনে জানালেন, যত শীঘ্র সম্ভব পরিবারের কাছে ফিরবেন।

বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার কাছে পিয়াসের কথা বলেছিলাম। কেউই তাঁকে চিনতে পারেননি। আবার সাহায্যের আশ্বাসও দিতে পারেননি। তাঁরাও যে তখন, কবে জেলে আছেন, কবে বাইরে— নিজেরাও জানেন না। কিন্তু পুলিশের উপরে বিরোধী দলের কর্মীদের আক্রোশের কারণও বুঝি কম নেই। মানবাধিকার কর্মীদের হিসাবে, এ ভাবে পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে ৫০০-র বেশি বিরোধী কর্মী আর কোনও দিন ফিরে আসেননি। পিয়াস সৌভাগ্যবান, ‘আয়নাঘর’ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bangladesh Unrest Aynaghar Bangladesh political prisoners

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy