Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘এমএইচ’ আতঙ্ক ভোলাতেই মরিয়া উৎসব

বোর্ডিং পাস নেওয়ার পর সহযাত্রীরা যে পরস্পরকে এমন ভয় মাখানো করুণার চোখে দেখতে পারেন, সেটা জানাই হতো না, যদি না এই প্লেনটা ধরতাম। রাত সাড়ে ১২টা। বঙ্গোপসাগরে এয়ারপকেট, মিনিট দশেকের হাল্কা দুলুনি। দেখলাম, অদূরের সিটে নবদম্পতি একে অন্যের হাতদু’টো আঁকড়ে ধরেছেন। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার আনন্দে কালি ছিটিয়ে দিচ্ছে একটা চাপা ভয়।

ইন্দ্রনীল রায়
কুয়ালা লামপুর শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

বোর্ডিং পাস নেওয়ার পর সহযাত্রীরা যে পরস্পরকে এমন ভয় মাখানো করুণার চোখে দেখতে পারেন, সেটা জানাই হতো না, যদি না এই প্লেনটা ধরতাম।

রাত সাড়ে ১২টা। বঙ্গোপসাগরে এয়ারপকেট, মিনিট দশেকের হাল্কা দুলুনি। দেখলাম, অদূরের সিটে নবদম্পতি একে অন্যের হাতদু’টো আঁকড়ে ধরেছেন। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার আনন্দে কালি ছিটিয়ে দিচ্ছে একটা চাপা ভয়।

ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জাবি মহিলা তাঁর শাশুড়িকে বলছেন, ‘‘চলো, অ্যাক্সিডেন্ট নেহি হুয়া।’’

টুকরো ছবিগুলোর নেপথ্যের কারণটা বুঝতে হয়তো ভুল করিনি— গন্তব্য যে মালয়েশিয়া!

কুয়ালা লামপুরের ৮৮ তলা পেট্রোনাস টাওয়ারের আশেপাশের নিয়ন সাইনগুলো জ্বলে-নিভে যত বার বলছে ‘মালয়েশিয়া ২০১৫— আ ইয়ার অব সেলিব্রেশনস’, তত বারই মনে হচ্ছে, এ সবই যেন যেন একটা তারিখকে ভুলে যাওয়ার প্রচণ্ড চেষ্টা।

৮ মার্চ, ২০১৪। ওই দিনই ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স-এর উড়ান, অভিশপ্ত এমএইচ-৩৭০। আজ পর্যন্ত যার কোনও হদিস নেই। শুধু কি ৮ মার্চ? মাত্র ক’মাস পরে ১৭ জুলাই সেই মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সেরই আর একটা উড়ান, এমএইচ-১৭-কে ইউক্রেনের ডনেৎস্ক-এ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নামিয়েছিল জঙ্গিরা।

এখন প্লেনে মালয়েশিয়া আসা মানেই যেন একটা আতঙ্ক চেপে বসা। উড়ানে সহযাত্রীদের চোখমুখ কিছুটা মালুম দিয়েছিল। আর রাজধানী কুয়ালা লামপুরে নেমে দেখছি, ‘এমএইএচ’ বিপর্যয়ের সঙ্গে আজও ঘর করছেন মানুষগুলো।

এবং তাঁদের জন্যই ‘আ ইয়ার অব সেলিব্রেশনস’-এর মোড়কে এ বারের আইফা পুরস্কার এ দেশে নিয়ে এসেছে মালয়েশিয়া সরকার। শোনা গেল, এই বছর অন্য কোনও দেশেই হওয়ার কথা ছিল বলিউডের এই হাইভোল্টেজ আন্তর্জাতিক তারকা সম্মেলন। কিন্তু মালয়েশিয়ার পর্যটন দফতর নাকি আইফা কর্তাদের প্রায় হাতেপায়ে ধরে অনুষ্ঠানটা তাঁদের দেশে নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য একটাই— যাতে একটু হলেও দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করা যায়।

আশ্বস্ত করতে চাইছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স-ও। সেই কারণেই প্রথম দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে আইফা-র মেন্টর অনিল কপূরের হাতে বিমানসংস্থার তরফে তুলে দেওয়া হল একটা ‘এয়ারবাস এ-৩৮০’-র মিনিয়েচার মডেল। কিন্তু অন্য ভয়ও রয়েছে। বিমান বা বিমানসংস্থা নিয়ে বেশি প্রচার হলে শেষে যদি উল্টো ফল হয়!

হয়তো তাই আইফার গ্ল্যামারের পৃথিবীতে বিমান দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে কেউ বিশেষ মুখ খুলছেন না। অন্তত প্রকাশ্যে। বেশির ভাগ তারকাই অবশ্য হোটেলের লবিতে চেনা সাংবাদিককে দেখে একান্তে বলছেন, ‘‘সত্যি না, কী অদ্ভুত। এখনও খুঁজে পাওয়া গেল না প্লেনটা!’’ কিন্তু সামনাসামনি ডিক্টাফোন অন করলেই অন্য সুর, ‘‘ওই প্রসঙ্গটা তুলবেন না। এখানে দু’দিন একটু মজা করি।’’

খুব স্বাভাবিক। আইফা-র দুনিয়ায় সত্যিই ‘এমএইচ’ নেই। সেখানে ‘খবর’ কোনগুলো? হৃতিক রোশন তাঁর বাবাকে নিয়ে বইয়ের উদ্বোধনে বোন সুনয়নার সঙ্গে ‘ফেসটাইম’-এ ভিডিও কল করছেন, ঝাঁ-চকচকে সুরিয়া মলে ‘দিল ধড়কনে দো’র প্রিমিয়ার শোয়ে নায়ক-নায়িকাদের পোশাক-আশাক, এই সব আর কী।

কিন্তু কুয়ালা লামপুরের রাস্তার খবর কী?

‘‘আমার প্রতিবেশী তার বোন আর বৌ-কে হারিয়েছে সেই ফ্লাইটটায় (এমএইচ ৩৭০)। তার পর থেকে সে আর বাড়ি থেকে বেরোয় না। রোজ রোজ নতুন মনোবিদের কাছে তাকে নিয়ে যায় বন্ধুরা। তাকে কি বলিউডি নাচাগানা দিয়ে ভোলানো যাবে? মনে হয় না’’— শনিবার বিকেলে পেট্রোনাস টাওয়ার লাগোয়া বাগানে বসে বলছিলেন বছর পঞ্চাশের ইতিহাসের শিক্ষক লি চেন।

লি একা নন। বাসচালক হোন কি ট্যুরিস্ট গাইড— এমএইচ-৩৭০-র কথা বললেই শহরটার আমজনতা কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট বাসের এক চালক বলছিলেন, ‘‘আগে দিনে চার বার করে শুধু এয়ারপোর্টের ট্রিপ মারতাম। এখন তিন দিনে এক বার যাই। কেউ আর আমাদের দেশে আসতেই চায় না। মালয়েশিয়া আসা মানে এখন মৃত্যুভয় চেপে বসা।’’

সত্যিই দেখলে অবাক লাগবে— এটাই কি সেই কুয়ালা লামপুর? পর্যটকদের মিছিল লেগে থাকত যে শহরে! হিন্দি ছবির ভক্তদের কেউ কেউ যমজ টাওয়ারের মাঝখানের ব্রিজটার দিকে আঙুল তুলে বলতেন, ‘‘শাহরুখের ডন-এ ওই ব্রিজটার ওপর দিয়েই ছেলেকে পিঠে নিয়ে পালিয়েছিল অর্জুন রামপাল!’’ কোথায় গেল সেই ভিড়? পর্যটক এতই কমে গিয়েছে যে, শহরের রাস্তাঘাট বিকেল হলেই প্রায় ফাঁকা। শপিং মলগুলোতে ঝুলছে ‘স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল’-এর বোর্ড। মোটে রাত ৯টায় রেস্তোরাঁগুলো প্রায় খালি। বিমান বিপর্যয়ে দেশের অর্থনীতি কতটা ধাক্কা খেয়েছে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।

তাই ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা। তাই শহর জুড়ে চাঁদের হাট। হৃতিক, প্রিয়ঙ্কা, ফারহান, অনুষ্কা, সোনাক্ষী, বিপাশা-দের নিয়ে রোববার বিকেলের অ্যাওয়ার্ড শো-র প্রস্তুতি সত্যিই চলছে ‘ইয়ার অব সেলিব্রেশন’-এর থিম মেনে।

কেউ অবশ্য মুখ ফুটে বলছে না, হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ষোলোতম আইফা-র সবচেয়ে বড় থিম হয়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে সেই অভিশপ্ত ‘এমএইচ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE