Advertisement
E-Paper

রেকর্ড গড়ল সিডনির বাঙালি সমাবেশ

একটা প্রশ্নের জবাব দিই আগে। সিডনির বৈশাখী মেলা এ বার এত দেরিতে হল কেন? এই মেলাটি হয় সিডনির সবচেয়ে বড় ভেন্যু অলিম্পিক ভিলেজের এএনজেড স্টেডিয়ামে। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মাণ করা হয় এখানকার অলিম্পিক ভিলেজ।

ফজলুল বারী

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ১৯:০১
এএনজেড স্টেডিয়ামে সিডনি বৈশাখী মেলার এলাহী আয়োজন। নিজস্ব চিত্র।

এএনজেড স্টেডিয়ামে সিডনি বৈশাখী মেলার এলাহী আয়োজন। নিজস্ব চিত্র।

একটা প্রশ্নের জবাব দিই আগে। সিডনির বৈশাখী মেলা এ বার এত দেরিতে হল কেন?

এই মেলাটি হয় সিডনির সবচেয়ে বড় ভেন্যু অলিম্পিক ভিলেজের এএনজেড স্টেডিয়ামে। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মাণ করা হয় এখানকার অলিম্পিক ভিলেজ। এখানে অনেকগুলো স্টেডিয়াম। সবচেয়ে বড় স্টেডিয়ামটি এএনজেড স্টেডিয়াম। খুব ব্যস্ত শিডিউল এই ভেন্যুর। দুনিয়ার নামকরা শিল্পীরা সিডনি এলে তাদের কনসার্টও এখানে হয়। এ বার পয়লা বৈশাখের সময় এই ভেন্যুতে চলছিল ইস্টার শোয়ের নানা আয়োজন। প্রতি বছর ইস্টারের সময় অলিম্পিক ভিলেজের স্টেডিয়ামগুলোয় জমজমাট এই ইস্টার শো চলে। ওই সময়ে ভেন্যু ভাড়া পাওয়া যায়নি বলেই এ বার মেলা আয়োজনে এই ১৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

প্রশান্ত পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালির সংখ্যা ৫০-৬০ হাজারের বেশি হবে না। বলা বাহুল্য এর নব্বুইভাগ অথবা এরও বেশি বাংলাদেশি বাঙালি। পৃথিবীর বহু জাতি-ভাষার মানুষের বহুজাতিক সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ও অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে ভারতীয়দের মধ্যেও বাঙালিরা সংখ্যালঘু। ভারতীয় সুখী বাঙালিরা হয়তো নিজের দেশের অন্য ভাষাভাষীদের তুলনায় দেশ থেকে বেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত সে ভাবে আসতে চাননি, হয়তো ঝামেলা মনে করেছেন, নয়তো দেরি করে বেরিয়েছেন। সে যাই হোক এখানেও বাংলাদেশি বাঙালি ও ভারতীয় বাঙালিরা হরিহর আত্মা। পুজো ও একুশে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবস এঁরা একসঙ্গে পালন করেন। আর একটা দিনের অপেক্ষায় সবাই থাকেন সারাটি বছর। অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলার জন্য। বিদেশ বিভুঁইয়ে পুজোর মতো সবার বাহারি শাড়ি-পাঞ্জাবি পরার এ এক মস্ত সুযোগ।

আরও পড়ুন: পর্তুগালের মেষপালক ভাইবোন সন্ত

এই মেলার বয়স এবার পঁচিশে পড়েছে। প্রথম প্রথম এখানে সেখানে নানা ভেন্যুতে চললেও গত টানা ১২ বছর ধরে মেলাটি হচ্ছে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। যার শুধু এক দিনের ভেন্যু ভাড়াই এক লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার (প্রায় ৪৮ লক্ষ ভারতীয় টাকা)। এখানকার আরও যত আয়োজন টিকিট বিক্রি, লাইট-সাউন্ড সহ সব ব্যবস্থাপনা অলিম্পিক ভেন্যুর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে করাতে হয়। জনে জনে গাড়ি পার্কিং-এর জন্যেও আলাদা গুনতে হয় তিরিশ-চল্লিশ ডলার। মোট কথা কোনও একটি পরিবারের মেলায় যেতে হলে তাদের দেড়-দু’শো ডলার এমনিই খরচ হয়ে যায়। তবু টাকাটা বড় নয়, এ মেলা নিয়ে সবার আবেগটাই বড়। পৃথিবীর দু’শোর বেশি দেশ-জাতি-ভাষাভাষী মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ভেন্যুর ব্যয় চিন্তা করে এখানকার আর কোনও জাতি অলিম্পিক পার্কে তাদের কোনও কর্মসূচি পালনের সাহস করেনি। আর বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখী মেলা টানা ১২ বছর ধরে এই অলিম্পিক স্টেডিয়ামেই চলছে! অলিম্পিক ভিলেজের সিইও চার্লস মোরে বললেন, কোন সম্প্রদায় তাদের কোনও একটি উৎসব ১২ বছর ধরে অলিম্পিক পার্কে করে আসছে— এটি তাদের কাছেও একটি রেকর্ড।

স্টেডিয়াম জুড়ে বাঙালি দর্শক সমাবেশ ছিল চোখে পড়ার মতো।

এই মেলাকে কেন্দ্র করে তিন মাস আগে থেকে মহড়া করেন অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীরা। মা-বাবা তাদের বাচ্চাদের কোনও একটি নতুন গান গাইতে বা নাচ নাচতে শেখান। প্রতি বছর এক জন অতিথি শিল্পীকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়। গত বছর এসেছিলেন নচিকেতা। এ বার বাংলাদেশ থেকে এসে গান শুনিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর কুমার। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় কত বাঙালি ছেলেমেয়ে যে সাংস্কৃতিক কর্মকণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের কত যে ব্যান্ড দল রয়েছে, ফ্যাশন শো-র সঙ্গে কত ছেলেমেয়ে যে জড়িত— এ মেলায় যারা আসেননি, তাঁরা ধারণাই করতে পারবেন না।

সিডনির অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলাকে বলা হয় ভারত ও বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বড় বাঙালি সমাবেশ! বিদেশের পুজো থেকে শুরু করে বেশির ভাগ অনুষ্ঠান হয় মিলনায়তনের ভিতরে। আর এই বৈশাখী মেলার অনুষ্ঠান-সমাবেশটি হয় স্টেডিয়ামের উন্মুক্ত স্থানে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, এখানে যারা আসেন তাঁরা কেউই পয়সা না-দিয়ে মেলায় ঢোকেন না। লাইনে দাঁড়িয়ে বা আগেভাগে অনলাইনে টিকিট কেটে ঢোকেন। এর জন্য মেলায় কত লোক এসেছেন, সে হিসাবটিও পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু পরিষদ অস্ট্রেলিয়া সিডনির এই বৈশাখী মেলার আয়োজক। এ সংগঠনের সভাপতি শেখ শামীমুল হক আমাদের জানিয়েছেন, এ বারের মেলায় কুড়ি হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন। বাঙালি ছাড়া অস্ট্রেলিয়ানরাও যোগ দিয়েছেন মেলায়।

বৈশাখী মেলা উপলক্ষে প্রতি বছর কোনও এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু পদক। এ বার এই পদক দেওয়া হয়েছে সিডনির বিখ্যাত চিলড্রেন হসপিটালকে। শিশু চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার এই হাসপাতালকে সম্মাননাটি দিয়েছে সিডনির বাঙালিরা। আর একটি মজার ঘটনা ঘটে এ মেলাকে ঘিরে। অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণত উন্মুক্ত স্থানে রাজনৈতিক সভা মিছিল হয় না। বা এ সবে যোগ দেবার মতো সময়ও মানুষের নেই। তাই এই মেলায় এক জায়গায় এত মানুষ পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনীতিকরা এখানে এসে বক্তৃতা দেবার সুযোগটি হাতছাড়া করেন না।

মঞ্চে তখন বাংলা গানের ছন্দে নৃত্য পরিবেশন করছেন নৃত্যশিল্পীরা।

এবারের মেলায় নতুন সংযোজন ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ উপলক্ষে ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ সহ নানাকিছু আনানো হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মেলার মঞ্চে একটি পথনাটক মানুষের মন ছুঁয়েছে। অন্যবার মেলার শেষে আতসবাজির আয়োজন করা হতো। এ বার করা হয় লেসার শো।

সব মেলার মতো এখানকার মেলাতেও খাবারের স্টলের এলাকাটি বড়সড় জমজমাট থাকে। বাঙালির সব খাওয়াদাওয়া পাওয়া যায় এ মেলায়। এমন কী ফুচকা-চটপটি পর্যন্ত। মেলা শেষে পার্কিং এর লিফটে চড়ে আট তলায় যেতে যেতে এক দম্পতির কথা কানে আসে। স্ত্রী তার স্বামীকে বলছিলেন, ‘‘লুচি-লাবড়াটা এমন টেস্ট হয়েছে না, একবারে কলকাতার পুজোর কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে।’’

এই হচ্ছে সিডনির বাঙালির প্রাণের মেলা।

Australia Bengali New Year Sydney Baishakhi Mela
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy