১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলাম আজ়ম। তার বহু বছর পরে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির হন। তবে গত সাত দশকে ডাকসু দখল তো দূরের কথা, জামাত কোনও নির্বাচনেই এখানে দাঁত ফোটাতে পারেনি। কিন্তু এ বার জামাতের ডাকসু দখলকে অনেকেই মনে করছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌলিক আদর্শের উপরে আঘাত। যে আদর্শ ভাষাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির উপরে দাঁড়িয়ে।
সদ্যসমাপ্ত ডাকসু নির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)-সহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জয়ী হয়েছেন শিবিরের প্রার্থীরা। সে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আওয়ামী লীগের কাজকর্ম নিষিদ্ধ হওয়ার জাতীয় রাজনীতিতে যেমন দ্বিদলীয় অবস্থা ভেঙে গিয়েছে, তেমনই ছাত্র লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘‘ছাত্র দলের উপযুক্ত নেতৃত্ব এবং রণকৌশলের অভাব স্পষ্ট। তার পুরো সুযোগ নিয়েছে শিবির। জুলাই গণআন্দোলনের পাশাপাশি, ক্যাম্পাসে নয়া সমীকরণের পুরো ফায়দাই নিজেদের দিকে শিবির টেনে নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা-বিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি পড়ুয়াদের প্রভাবিত করতে পারছে, এটাই উদ্বেগের।’’
যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন-সহ ছ’দফা দাবি এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ জামাত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ায় হতাশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা। তাঁদের মতে, ডাকসুর ফলাফল মুক্তমনা বাঙালির চেতনায় আঘাত। সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ বদরুল আহসনের কথায়, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিরকালই ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধীন চিন্তা ও ভাষাভিত্তিক রাজনীতির কেন্দ্র। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এখান থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল। সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূতিকাগারে স্বাধীনতা বিরোধীদের জয় নিঃসন্দেহে মুক্তমনা বাঙালিকে ধাক্কা দেবে। জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়তে পারে।’’ ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনামের কথায়, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক, পড়ুয়াদের হত্যার মধ্য দিয়ে ৭১-এ বাঙালি নিধনযজ্ঞের সূত্রপাত। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানি ভাবধারার উগ্র সাম্প্রদায়িক কোনও গোষ্ঠীর আস্ফালন প্রত্যাশিত নয়।’’
ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে জামাতের এক নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করতে হবে। ভিডিয়োতে ছাত্রনেতাদের ক্লাসরুমে হিজাব বলে স্লোগান দিতেও দেখা গিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনে বিপুল অর্থ ঢালা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, শিবির-জামাত জোটের হাতে যথেষ্ট অর্থ ও সম্পদ রয়েছে। যা দিয়ে বাংলাদেশের নতুন রাজনীতিকে প্রভাবিত করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সব শিবিরকর্মীই জুব্বা পরা নন। অনেকে জিন্স, স্নিকার্স আর টি-শার্ট পরে ঘোরেন। এগুলোই ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের সামাজিক-ধর্মীয় প্রেক্ষাপট সম্ভবত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)