বর্তমানে রয়েছেন সৌদি আরবে। সেখান থেকে যাবেন কাতার। তার পর সংযুক্ত আরব আমিরশাহি হয়ে দেশে ফিরবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পশ্চিম এশিয়ার ত্রিদেশীয় সফর ঘিরে শুরু হয়েছে জোর চর্চা। কেউ কেউ আবার এ-ও বলছেন, এই সফরকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিছক সরকারি সফর হিসাবে দেখা উচিত নয়, এর পিছনে রয়েছে ধনকুবের ট্রাম্পের ব্যবসায়িক হিসাবনিকাশ। কেন এমন দাবি? ইঙ্গিতটা লুকিয়ে আছে আরব-সাম্রাজ্যে ট্রাম্প পরিবারের ব্যবসা বৃদ্ধির অঙ্কে।
সংবামাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্পের পারিবারিক ব্যবসা তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ওভাল অফিসে প্রবেশের পরও সেই ধারা অব্যাহত।
বেদুইনদের দেশে গগনচুম্বী বিলাসবহুল ভবন, গল্ফ কোর্স হোক বা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা— এই সব নিয়ে যখন তাঁর পারিবারিক কোম্পানি পরিকল্পনা করছে, সেই সময়ই আরব সফরে গেলেন ট্রাম্প! অনেকের মতে, তিনি কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবেই নয়, বরং এক ব্যবসায়িক পরিবারের প্রধান হিসাবেও গিয়েছেন। কারণ, অদূর ভবিষ্যতে এই দেশগুলিতে তাঁর পারিবারিক ব্যবসা প্রসারিত হবে, তা স্পষ্ট।
পশ্চিম এশিয়ার এই দেশগুলির সঙ্গে ট্রাম্পের আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে সরকারি নীতিনির্ধারকদের একাংশ। উপভোক্তা অধিকার রক্ষাকারী গোষ্ঠী ‘পাবলিক সিটিজ়েন’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রবার্ট ওয়েইসম্যানকে উদ্ধৃত করে সিএনএন বলেছে, ‘‘আমেরিকার জনগণ যখন তাঁদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন, তখন তাঁরা আশা করেন, সেই ব্যক্তি তাঁদের জন্যই কাজ করবেন, ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়।’’ ওয়েইসম্যানের মতো পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের এই ধরনের আর্থিক সংযোগ বিদেশি শক্তিগুলির আমেরিকার নীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করে।
যদিও ট্রাম্প সেই সব যুক্তিকে মান্যতা দিতে নারাজ। তাঁর কর্মকাণ্ড বলছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন নিজের ব্যবসায়িক উদ্যোগ বৃদ্ধি করতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও তিনি যে নিজের ব্যবসায়িক সত্তাকে মুছে ফেলেননি, তা বার বারই মনে করিয়ে দিয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে এক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘‘সব সময়ই আমার অর্থ উপার্জনের প্রবণতা ছিল।’’ সেই সম্মেলনে আমেরিকাকে বিনিয়োগের উপযুক্ত স্থান হিসাবে তুলে ধরেছিলেন ট্রাম্প। তবে সেই সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
ট্রাম্পের মতো ইতিহাস অন্য কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টের নেই বললেই চলে। অতীতে কেউ যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বসেছেন, তার আগেই নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা হয় বন্ধ করে দিয়েছিলেন, নয়তো কোনও বেনামি ট্রাস্টের নামে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প সেই সব কোনও পথেই হাঁটেননি। তিনি বুঝিয়েছেন, রাখঢাক রাখা পছন্দ করেন না। তাঁর সব সম্পত্তি ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’ নামে এক ট্রাস্টের নামে রয়েছে। সেই ট্রাস্ট পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ট্রাম্পের সন্তানেরা।
গত জানুয়ারিতে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’ জানিয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কোনও বিদেশি সরকারের সঙ্গে নতুন চুক্তি করবে না তারা!। কিন্তু বাস্তবে কি সেই প্রতিশ্রুতি পালন হচ্ছে? সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাতারে ‘ট্রাম্প-ব্র্যান্ডেড’ গল্ফ কোর্সের জন্য সম্প্রতি যে চুক্তি হয়েছে, তাতে বিনিয়োগ করছে সে দেশেরই একটি সরকারি সংস্থা! ট্রাম্প-পুত্র এরিক দাবি করেন, কাতারের ওই সংস্থা এবং অন্য একটি নির্মাণকারী সংস্থার মাধ্যমে কাতারে ‘ট্রাম্প ব্র্যান্ড’ সম্প্রসারণ করতে পেরে গর্বিত।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বার বারই দাবি করেছেন, তিনি আমেরিকার জয় চান। শুধু তা-ই নয়, উপসাগরীয় দেশগুলির থেকে আর্থিক সহায়তাও চাইতে দেখা গিয়েছে ট্রাম্পকে। চলতি সফরে ট্রাম্প ৬০ হাজার কোটি ডলারের (৫১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি) দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি করেছেন সৌদির সঙ্গে! আমেরিকায় ওই অঙ্কের বিনিয়োগ করবে রিয়াধ। তবে সমালোচকদের মতে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম থেকেই তাঁর কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট, প্রেসিডেন্ট পদে থাকলেও ব্যক্তিগত ভাবে তিনি অর্থ উপার্জন করতে আগ্রহী! কেউ কেউ আবার আশঙ্কা করছেন, বিদেশি শক্তিরা তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য পূরণ করতে ট্রাম্পের এই আগ্রহকেই কাজে লাগায়।
ট্রাম্প কেন এত পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির প্রতি উদার? ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ট্রাম্পের এক দল সমর্থক মার্কিন ক্যাপিটলে হামলা চালায়। এই ঘটনা ট্রাম্পের জন্য ধাক্কার কারণ ছিল। সেই সময় আমেরিকার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ অংশ থেকেই ট্রাম্প ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে যান। বেশ কিছু সমাজমাধ্যম অ্যাপও তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমনকি, একটি সফট্অয়্যার কোম্পানি ট্রাম্পের প্রচার ওয়েবসাইটের জন্য অর্থ দেওয়া বন্ধ করেছিল। বিভিন্ন নামকরা আর্থিক সংস্থাও ট্রাম্পের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, ওয়াশিংটনে থাকা ট্রাম্পের নামাঙ্কিত হোটেলও কার্যত ফাঁকা হয়ে যায়। সেই সঙ্কটের সময় কিছু ‘বন্ধু’ ব্যবসায়ী ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন পশ্চিম এশিয়ার বন্ধুরাও।
ওমানেও ‘ট্রাম্প-ব্র্যান্ড’ সুদূরপ্রসারী। সে দেশের সরকারের পর্যটন শাখা ২০২২ সালে রাজধানী মাস্কাটের কাছে ট্রাম্প-ব্র্যান্ডেড রিসর্ট, ভিলা এবং একটি গল্ফ ক্লাব নির্মাণের পরিকল্পনায় অংশীদারি করে। সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্প ক্ষমতায় না থাকাকালীন এই চুক্তিগুলি বাস্তবায়িত হলেও গত নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের জয় পাওয়ার পর ওই অঞ্চলে তাঁর ব্যবসা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।