Advertisement
E-Paper

বেঁচে থাকব তো, ঘুম ভাঙতেই চিন্তা ওঁদের

সকাল সকাল নিজের দোকানের ঝাঁপ খুলে বসেছিলেন জগতার সিংহ লঘমানি। রোজকার মতোই শুরু হয়েছিল বিক্রিবাটাও।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৬ ০৯:০৯

সকাল সকাল নিজের দোকানের ঝাঁপ খুলে বসেছিলেন জগতার সিংহ লঘমানি। রোজকার মতোই শুরু হয়েছিল বিক্রিবাটাও। তাল কাটল ধারালো ছুরির সামনে। ছুরি উঁচিয়ে এক ব্যক্তি এসে দাবি করল, এই মুহূর্তে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে জগতারকে। নইলে গলা কেটে ফেলা হবে। মাস খানেক আগের এই ঘটনায় আশপাশের দোকানদার আর খরিদ্দারদের হস্তক্ষেপে রক্ষা পেয়েছিলেন জগতার। কিন্তু আতঙ্ক নিত্যসঙ্গী।

এই আতঙ্কের প্রহরেই দিন গুজরান করছেন আফগানিস্তানের একটা অংশের নাগরিক। যাঁদের পরিচয় শুধু আফগান নয়, তাঁরা হিন্দু অথবা শিখ। এক কথায়, অ-মুসলিম। চরম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার আবহে ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছেন তাঁরা।

‘হিন্দু ও শিখ জাতীয় কাউন্সিল’-এর চেয়ারম্যান অবতার সিংহ জানালেন, ১৯৯২ সাল পর্যন্তও সারা আফগানিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে ছিলেন দু’লক্ষ ২০ হাজার জন শিখ ও হিন্দু ধর্মের মানুষ। এখন রয়েছে মোটে ২২০টি পরিবার। তাঁর কথায়, ‘‘দিনের পর দিন হুমকির মুখে পড়ে ক্রমশ ছোট থেকে আরও ছোট হচ্ছে আমাদের সম্প্রদায়।’’

কয়েক শতাব্দী ধরে আফগানিস্তানের বাণিজ্য ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছেন শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায়। আগে এই বাণিজ্যের পরিধি অনেক বিস্তৃত হলেও, এখন মূলত ভেষজ গাছগাছড়া ও ওষুধের ব্যবসাই করেন বেশির ভাগ হিন্দু ও শিখ। অবতার সিংহও জানালেন সে কথা। বিভিন্ন এলাকা থেকে বিতাড়িত হতে হতে এখন মূলত পূর্ব আফগানিস্তানের কাবুল, গজনি ও নাঙ্গারহারেই বসবাস তাঁদের।

তবে ২০০১ সালে তালিবান শাসন উৎখাত হওয়ার আগের অবস্থাটা আরও খারাপ ছিল বলেই জানালেন অবতার। তখন রাস্তায় বেরোলে নিজেকে আলাদা করে চেনানোর জন্য মাথায় হলুদ কাপড়ের টুকরো বাঁধতে হতো হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের। কত জমি যে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তার হিসেব নেই। হিসেব নেই ধর্মের নামে বলি হওয়া অসংখ্য অ-মুসলিম মানুষের। হিসেব নেই, কত মানুষকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পণবন্দি করেছে তালিবান।

কাবুলের কাছে কালাচা এলাকায় কিছু বেশি হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা। সেখানে একটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বড় শ্মশান রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, মৃতদেহ দাহ করার সময়ও পুলিশি নিরাপত্তা লাগে তাঁদের। কারণ শবযাত্রা লক্ষ করে ইট পর্যন্ত ছোড়া হয়। আঘাত করা হয় মৃতদেহের উপরেও।

যদিও আফগানিস্তানের হজ এবং ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দহি-উল হক আবিদ জানালেন, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব আছে ঠিকই। তবে পরিস্থিতি এতটাও খারাপ নয়। বললেন, ‘‘ওঁদের মৃতদেহ পোড়ার গন্ধে অনেকেই অভিযোগ জানান। তাই শহরের বাইরে আলাদা করে শ্মশান তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ওঁদের।’’

শিশুদের মধ্যেও প্রকট হচ্ছে এই ভেদাভেদ। আট বছরের ছোট্ট জসমীত সিংহ বলল, সহপাঠীদের অত্যাচারে স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। ‘‘ওরা আমার পাগড়ি খুলে নেয়, অকারণে মারধর করে, ‘কাফের’ বলে গালি দেয় সব সময়।’’

‘‘মৃত্যুভয় সঙ্গে নিয়েই দিন শুরু করি আমরা। দিন শুরু করি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে।’’ —খরিদ্দারকে পাওনা টাকা মেটাতে মেটাতে বললেন জগতার সিংহ লঘমানি। কাবুলের বাজার অঞ্চলে ভেষজ গাছগাছড়া ও ভেষজ ওষুধের ছোট্ট একটি দোকান রয়েছে তাঁর। বললেন, ‘‘মুসলিম নয় মানে, ওদের চোখে সে মানুষই নয়। জানি না কোথায় যাব, কী করব!’’

জগতার এখনও জানেন না, তবে জেনেছেন অনেকেই। এ ভাবে দিন কাটানো অসম্ভব জেনে দেশ ছেড়েছেন বহু শিখ আর হিন্দু ধর্মের আফগান। ভারতে এসে নতুন করে জীবন শুরু করেছেন। তবে তাতে পরিস্থিতির বদল ঘটেছে কি? ঘটেনি। নিজের ধর্ম, জাতির পরিচয় হারিয়ে তাঁদের গায়ে সেঁটে বসেছে ‘বহিরাগত’ তকমা। কাবুলের আর এক দোকানদার বলজিত সিংহ বললেন, ‘‘ভারতে গেলেই ‘আফগান’ হিসেবে পরিচিত হই আমরা। অথচ সত্যিকারের আফগান হওয়া সত্ত্বেও, আফগানিস্তানের মাটিতে কোনও দিন এই পরিচয় স্বীকৃত হল না। আমরা এখানে বহিরাগত।’’

তবু প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে বাঁচছেন মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কিছু হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে দিশাহারা হয়ে প্রতি নিয়ত খুঁজে চলেছেন নিজের দেশ।

afghanisthan hindu sikh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy