Advertisement
E-Paper

রাতের অন্ধকারে উত্তর কোরিয়ায় ‘গণহত্যা’ মার্কিন নৌসেনার! ছ’বছর আগে কী ভাবে ব্যর্থ হয় ট্রাম্পের গোপন ‘মিশন’

সরকারি ভাবে ২০১৯ সালের ওই অভিযানের বিষয়ে কিছু জানায়নি পেন্টাগন। উত্তর কোরিয়া কখনও এই অভিযানের বিষয়ে জানতে পেরেছিল কি না, জানা যায়নি তা-ও। প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনও উত্তর দেননি ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২০:২৬
(বাঁ দিকে) কিম জং উন। ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডান দিকে)

(বাঁ দিকে) কিম জং উন। ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডান দিকে) — ফাইল চিত্র।

উত্তর কোরিয়ার গভীর সমুদ্রে গোপন অভিযান চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল মার্কিন নৌসেনা। তার পর রাতের অন্ধকারে নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে ফিরে গিয়েছিল দেশে। দেহ যাতে সহজে ভেসে না ওঠে, সে জন্য ধারাল অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছিল ফুসফুস। এত দিন পর এ বার এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আনল মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইম্‌স।

প্রেক্ষাপট

সে প্রায় বছর সাতেক আগের কথা। ২০১৮ সাল। তখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পরের বছরই মুখোমুখি পরমাণু সংক্রান্ত আলোচনায় বসার কথা ট্রাম্পের। বৈঠক হবে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উনের বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না বিশ্ব। তা ছাড়া, ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের সম্পর্কও ক্রমেই দোদুল্যমান হয়ে উঠছে। কখনও বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি আদানপ্রদান, তো কখনও প্রকাশ্যে পরমাণু হামলার হুঁশিয়ারি! কিন্তু হ্যানয়ে বৈঠক হতেই হবে। তাতে লাভ হবে দুই দেশেরই। দাবি, তখনই আঁটঘাট বেঁধে নৌসেনার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দলকে (নেভি সিল) উত্তর কোরিয়ায় পাঠানোর কথা ভেবে ফেলে ট্রাম্প প্রশাসন। ঠিক হয়, রাতের অন্ধকারে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে এক ধরনের বৈদ্যুতিন ডিভাইস বসিয়ে আসবে তারা, যাতে আড়ি পেতে শোনা যায় কিমের দেশের সমস্ত গোপন কথোপকথন। সঙ্গে জানা যায় পরমাণু পরিকল্পনার খুঁটিনাটিও।

প্রস্তুতি পর্ব

দু্র্ধর্ষ এই অভিযানের জন্য বেছে নেওয়া হল মার্কিন নৌসেনার অতি দক্ষ সিল টিম-৬ রেড স্কোয়াড্রনকে। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে নিকেশ করতে পাঠানো হয়েছিল এদেরই। তবে এ বারের অভিযান খানিক অন্যরকম। এই অভিযান এতই গুরুত্বপূর্ণ, যে একবার ধরা পড়লে সে দেশেই পণবন্দি হয়ে থাকতে হতে পারে নৌসেনার কমান্ডোদের। আবার গোপন এই মিশনের কথা কোনও ক্রমে জানাজানি হয়ে গেলে ভেস্তে যেতে পারে ট্রাম্প-কিম বৈঠকও। তাই এ হেন অভিযান কার্যকর করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরাসরি অনুমোদন দরকার। অবশেষে সেই অনুমোদন মিলল ২০১৮ সালের শেষার্ধে— ফেব্রুয়ারিতে হ্যানয়ে বৈঠকের মাত্র মাসখানেক আগে। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। দিনের পর দিন ধরে হিমশীতল জলে একটানা সাঁতার কাটা, রাতের অন্ধকারে শুশুকের মতো নিঃশব্দে জল ফুঁড়ে এগোনো— সবরকমের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন সিলের কমান্ডোরা।

মূল অভিযানের জন্য বাছা হল আট জনের একটি দল, যাঁরা হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় স্কুবা ডাইভিংয়ের পোশাক এবং নাইট ভিশন গগল্‌স পরে উত্তর কোরিয়ার জলে ঝাঁপ দেবেন। স্থির হল, প্রথমে পরমাণু অস্ত্রযুক্ত একটি ডুবোজাহাজে চেপে উত্তর কোরিয়ার জলসীমায় ঢুকবেন তাঁরা। থাকবে আরও দু’টি ছোট সাবমেরিন। শক্তিশালী রেডারেও ধরা প়়ড়বে না সেগুলি। মূল সাবমেরিন থেকে ছোট সাবমেরিনে চড়ে উপকূল থেকে কিছু দূরে এক বিশেষ জনশূন্য জায়গায় পৌঁছনো হবে। তার পর একে একে জলে নামবেন আট নৌসেনাকর্মী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতরে উপকূলে পৌঁছে নির্দিষ্ট জায়গায় বৈদ্যুতিন যন্ত্রটি বসিয়ে ফিরে আসবেন সাবমেরিনে। কিন্তু সমস্যা একটাই! সামনে কী রয়েছে, তা দেখার জন্য ড্রোন ব্যবহার করার উপায় নেই। অতএব ঝাপসা কৃত্রিম উপগ্রহচিত্রই ভরসা, যা কমান্ডোদের কাছে পৌঁছোবে কয়েক মিনিট দেরিতে। এক বার জলে ঝাঁপ দিলে মূল সাবমেরিনে থাকা বাকি আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগেরও কোনও উপায় নেই। ফলে সবটাই করতে হবে নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে।

অভিযান

২০১৯ সালের গোড়ার দিক। পরিকল্পনা মাফিক উত্তর কোরিয়ার উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল সিলের বিশেষ দল। তার আগে দীর্ঘ দিন ধরে ওই উপকূলে কড়া নজর রেখেছে মার্কিন নৌসেনা। কোন সময়ে মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে যান, কখন টহল চলে, কখন জনশূন্য থাকে সৈকত— সব তত দিনে মার্কিন নৌসেনার নখদর্পণে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, যদি একবার সিলের কর্মীরা রাতের অন্ধকারে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছোতে পারেন, তা হলেই কেল্লা ফতে! কোনও বাধা ছাড়াই উপকূলে পৌঁছে কাজ হাসিল করে ফিরতে পারবেন তাঁরা।

পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার নড়চড় হয়নি সেই রাতেও। সমুদ্র তখন শান্ত। নিঃসাড়ে উপকূলের দিকে এগোতে শুরু করল দুই সাবমেরিন। গোয়েন্দা তথ্য যা বলেছিল, ঠিক তাই! ডুবোজাহাজে থাকা সেন্সর বলছে, আশপাশে কোনও জনমানব নেই। নির্দিষ্ট স্থানে জলে ঝাঁপ দিলেন আট জন। কিন্তু অজান্তেই যে একটা ছোট ভুল হয়ে গিয়েছে, জানা ছিল না কারও। উপকূলের অদূরে তখন ভাসছিল মৎস্যজীবীদের এক নৌকা। নৌসেনার বিশেষ তাপীয় সেন্সরযুক্ত রাতচশমায় তা ধরা প়়ড়়েনি, কারণ নৌকায় থাকা সকলের পরনের পোশাক ছিল ভেজা।

সাঁতরে উপকূলে পৌঁছেই প্রথম আট জনের চোখে প়ড়ল নৌকাটি। সমুদ্রে ঠিক যেখানে সিলের সাবমেরিনটি থাকার কথা, ঠিক তার উপরেই যেন ভাসছে খুদে এক নৌকা! নৌকায় কারা রয়েছে, তীর থেকে তা বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো রয়েছে কিমের নৌসেনার দল। এ দিকে, সাবমেরিনে থাকা কমান্ডারের সঙ্গে কোনও ভাবেই যোগাযোগ করার উপায় নেই। যে কোনও মুহূর্তে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সাতপাঁচ না ভেবে রাইফেল উঁচিয়ে নৌকা লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করলেন তীরে থাকা দলের এক সিনিয়র কর্মী। রাইফেল তুলে নিলেন বাকিরাও। নৌকায় থাকা সকলকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার পর আর দেরি না করে বৈদ্যুতিন যন্ত্রটি না বসিয়েই ফের জলে ঝাঁপ দিলেন সকলে।

ফেরা

সাবমেরিনে নয়, প্রথমে ওই নৌকায় গিয়ে উঠলেন আট জন। তত ক্ষণে সকলের মৃত্যু হয়েছে। কারও পরনে কোনও সেনার পোশাক নেই, নেই অস্ত্রও। সকলেই ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাধারণ নাগরিক। কিন্তু এখন আর ‘ভুল’ শোধরানোর উপায় নেই। অগত্যা ধারাল অস্ত্র বার করে একে একে সব মৃতদেহের ফুসফুস ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হল, যাতে জলে ফেলে দিলেও দেহ ভেসে না ওঠে। তার পর নৌকাটি ও ভাবেই রেখে সাবমেরিনে করে চম্পট দিল সিলের রেড স্কোয়াড্রন— অভিযান সম্পূর্ণ না করেই। কেউ ঘুণাক্ষরেও জানল না আমেরিকার ব্যর্থ এই অভিযানের কথা।

সরকারি ভাবে ২০১৯ সালের ওই অভিযানের বিষয়ে কিছু জানায়নি পেন্টাগন। উত্তর কোরিয়া কখনও এই অভিযানের বিষয়ে জানতে পেরেছিল কি না, জানা যায়নি তা-ও। তবে নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সের দাবি, এর পর থেকেই সমুদ্রের ওই অঞ্চলে নৌসেনার টহল বাড়ানো হয়েছে। ঘটনাচক্রে এর কয়েক সপ্তাহ পরেই হ্যানয়ে পারমাণবিক শীর্ষবৈঠকে বসেন দুই রাষ্ট্রনেতা। তবে কোনও সমঝোতা হয়নি। বরং সে বছরের মে মাস থেকে ফের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু করে দেয় কিমের দেশ।

নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সের প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনও উত্তর দেননি ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। খোদ ট্রাম্পও বলেছেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এই প্রথম শুনছি!’’ অভিযোগ, মার্কিন কংগ্রেসের গোয়েন্দা বিভাগকেও গোপন এই অভিযানের বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি, যা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনাও শুরু হয়েছে।

US Mission North Korea Kim Jong Un Donald Trump
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy