ভোর সাড়ে চারটে। ঘুম ভেঙে গেল সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দে। তার পরেই বিস্ফোরণ!
খবর পেলাম, সেনা অভিযান শুরু হয়েছে বাড়ির অদূরে। উত্তরের শহরতলি স্যাঁ দেনিতে। বুঝতে পারছি, সুদূর সিরিয়া নয়। আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চলছে ঘরের পাশেই।
স্কুল, কলেজ, দোকানপাট— সব বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। পরিবহণ ব্যবস্থাও অচল। নিরাপত্তার জন্য ঘরবন্দি থাকতে বলা হয়েছে সাধারণকে। কে জানে, কোথায় ঘাঁটি গেড়েছে ওরা (জঙ্গিরা)...।
প্যারিসে যে দিন হামলা হল, সে দিনও বাড়িতেই ছিলাম। শহর সংলগ্ন মোঁদ এলাকায় বড় রাস্তার উপর আমার বাড়ি। স্যাঁ দেনি থেকে মিনিট কুড়ির দূরত্ব। টিভিতে হামলার সব খবর পাচ্ছিলাম। বিস্ফোরণের শব্দগুলোও কানে আসছিল। আইএস দমনে পর দিনই সিরিয়ায় বিমান হানা শুরু করল ফ্রান্স। আজ বুঝছি, সিরিয়া নয়, যুদ্ধটা চলছে ঘরের পাশেই।
পড়ুন: খেল খতম আবাউদের? সাত ঘণ্টার যুদ্ধ শেষেও ধোঁয়াশা
স্যাঁ দেনির বহুতলে একাধিক জঙ্গি লুকিয়ে থাকার খবরে আজ সেখানে পাল্টা হামলা চালিয়েছে ফরাসি সেনা। একের পর এক বিস্ফোরণ, সঙ্গে অনর্গল গুলিবর্ষণ। জোর তল্লাশি চলেছে অন্যত্রও। সেনা অভিযানের জেরে কার্যত থমকে গিয়েছিল শহরতলির জনজীবন। সাত ঘণ্টার সেনা-অভিযান শেষে দুপুর বারোটার কিছু পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
গত চার দিন ধরে এমনিতেই ফুটছে প্যারিস। তার পর আজকের অভিযান। মনে আতঙ্ক, আশঙ্কা নিয়েই বাড়ির কাছে একটি কফি শপে গিয়েছিলাম। টিভিতে তখন ভোরের সেনা অভিযানের খবর সম্প্রচার হচ্ছে। বোরখা পরা এক মহিলা সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। পর্দায় মহিলাকে দেখেই ক্ষোভ উগরে দিলেন আমার প্রতিবেশীরা। বেশ টের পাচ্ছি, বিদেশি হোক বা মুসলিম, বিশ্বাসের জায়গাটা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে ফরাসিরা। ধর্মবিদ্বেষ কড়া নাড়ছে দরজায়। যার শুরুটা জানুয়ারিতে। শার্লি এবদোর দফতরে হামলার পর।
তবে এটাও বলছি, ফরাসিরা এখন নিরপরাধ মুসলিম এবং জঙ্গিদের মধ্যে তফাতটা করতে জানে। আইএস জঙ্গিরা যে ধর্মটাকে স্রেফ ব্যবহার করছে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষও সেটা বুঝছেন।
পেশার খাতিরে প্যারিসের অফিস পাড়ায় আমার নিত্য যাতায়াত। সেখানকার ছবিটা অবশ্য কিছুটা অন্য রকম। হামলার ক্ষত দগদগে। অলিতে গলিতে শোকের ছায়াও স্পষ্ট। বাতাক্লাঁ কনসার্ট হল, লা কাসা নোস্ত্রা রেস্তোরাঁ, পোতি কাম্বোজ রেস্তোরাঁ..., জায়গায় জায়গায় ফুলের স্তূপ। সঙ্গে সারি সারি মোমবাতি। তবু স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে চনমনে প্যারিস। ‘‘ওরা (জঙ্গিরা) আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল..., আমরা ভয় পাইনি। জীবন চলতে থাকবে’’— বলছিলেন এক বন্ধু।
চলছে অভিযান। বুধবার প্যারিসের স্যাঁ দেনিতে। ছবি: রয়টার্স
প্যারিসে হামলার পর দিনই বেলা বারোটায় এক মিনিটের নীরবতা পালন হয়েছিল ফ্রান্সের সর্বত্র। শুরু হয়েছে অফিস-কাছারিও। তবে শহরের আনাচেকানাচে এখন ফরাসি সেনার টহল। বিশেষত বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে চলছে কড়া নজরদারি। হামলা-বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতেও ক্ষত লুকনোর চেষ্টা চলছে। সংলগ্ন অফিসগুলিতেও কাজে ফিরেছেন কর্মীরা। ছেলেমেয়ের হাত ধরে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছেন বাবা-মা। তবে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা শপিং মল, বাজারহাট। বড়দিনের আগের সময়টায় এমনিতে প্যারিসের রাস্তায় পা ফেলা ভার হয়ে ওঠে। এ বার সব কিছু আলাদা। চেনা শহরের ছবিটা মেলাতে পারছি না। বন্ধু ক্রিসটসের মা গ্রিক, বাবা আফ্রিকান। হামলার প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের মতো আমার জন্মও এখানেই। ওদের সঙ্গে কী এমন হল, যে এটা করল। এটা ধর্ম নয়। এটা বর্বরতা। এটা যুদ্ধ।’’
পড়ুন: ব্যারিকেডে ‘ইম্যাজিনে’র সুর, অস্ত্রে শান শিল্পীদের
পরিস্থিতি যা বুঝছি, হামলার পর গোটা শহরটা... থুড়ি দেশটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটা দলের প্রতিরোধস্পৃহা তীব্র। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের বিমান অভিযানকে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন। আর একটা দল ইটের বদলে পাটকেলের তত্ত্বে ভুলছেন না। তাঁদের ধারণা, সিরিয়ায় ফরাসি বিমান হানার জেরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যেতে পারে। আমারও তাই মত।
কানাঘুষো শুনছি, জঙ্গি দমনে এ বার আড়ি পাতবে ফরাসি সরকারও। নজরদারির আওতায় আসবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, এমনকী ব্যক্তিগত ফোন কলও। খবরটা অবশ্য যাচাই করতে হবে। বুঝতে পারছি, সাধারণের নিত্য জীবনেও আঁচ লাগছে যুদ্ধের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy