গত ১১৭ বছর ধরে ব্যাঙ্কের অন্ধকার ভল্টই ছিল তাদের ঠিকানা! ঢাকার সেই নবাবি রত্নভান্ডারের ১০৯টি মণিমাণিক্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম আকর্ষণ হল দরিয়া-ই-নূর। মোগল এবং ব্রিটিশ জমানায় যে হীরকখণ্ডের পরিচিত ছিল ‘কোহিনূরের সহোদর’ হিসেবে। কারণ, কোহিনূরের মতোই বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের গোলকুন্ডার কাছে কাকতীয় রাজন্যবর্গের হিরের খনি থেকে উত্তোলিত হয়েছিল দরিয়া-ই-নূর। যার অর্থ ‘আলোর নদী’।
লন্ডনের রাজকীয় ‘জুয়েল্স অফ ক্রাউন’-এর প্রধান আকর্ষণ ১০৫ ক্যারাটের কোহিনূরের তুলনায় অবশ্য আকারে অনেকটাই ছোট ঢাকার নবাবি পরিবারের সম্পত্তি দরিয়া-ই-নূর। মাত্র ২৬ ক্যারাট। কিন্তু অনবদ্য ‘টেবল্ কাট’ একে দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে রত্নপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় করে রেখেছিল। পরবর্তী সময়, মরাঠা সাম্রাজ্য, হায়দরাবাদের নিজামশাহি, শিখ মহারাজা রণজিৎ সিংহের কোষাগার ঘুরে তা পৌঁছয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। ১৮৫২ সালে কোম্পানির নিলামে সেটি ৭৫ হাজার টাকায় কিনে নেন ঢাকার তৎকালীন নবাব খাজা আলিমুল্লা।
বাংলাদেশের সরকারি নথিতে ইঙ্গিত, ১৯০৮ সালে ঢাকার তৎকালীন নবাব সলিমুল্লা অসম এবং বাংলার প্রাদেশিক সরকারের থেকে ১৪ লক্ষ ঋণ নিয়েছিলেন ৩ শতাংশ সুদে। বিনিময়ে দরিয়া-ই-নূর-সহ ১০৯ রত্ন বন্ধক রেখেছিলেন। ব্রিটিশ জমানায় সেগুলি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ‘ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া’র ভল্টে রক্ষিত ছিল। কিন্তু সলিমুল্লা ঋণ শোধ করতে পারেননি। এর পরে প্রথমে ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তান’ পরে ঢাকার সোনালি ব্যাঙ্কের ভল্টে সংরক্ষিত রয়েছে সেগুলি। তবে সরকারি নথিপত্রে সোনালি ব্যাঙ্কের ভল্টে নবাব পরিবারের ১০৯ ধরনের রত্ন থাকার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও সেগুলির মধ্যে দরিয়া-ই-নূর আছে কি না, তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন জানাচ্ছে, প্রায় ১০ বছর আগে দরিয়া-ই-নূর লেখা একটি প্যাকেট মতিঝিলে সোনালি ব্যাঙ্কের শাখায় স্থানান্তর করা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান (চেয়ারম্যান) আশফাক হোসেন বলেন, ‘‘বাংলার দরিয়া-ই-নূরকে অসূর্যম্পশ্যা বললে ভুল হবে না। আজ পর্যন্ত কোনও ক্যামেরার আলোর ঝলকানিতে এর সৌন্দর্য ধরা যায়নি। কিংবা কখনও গোপনে তোলা হলেও প্রকাশিত হয়নি! আর কেউ ছবি তুলবেই বা কী ভাবে? জায়গা বদলালেও শতবর্ষ ধরেই এই হিরে ব্যাঙ্কের গোপন কুঠুরিতে পড়ে আছে।’’ তিনি জানান, আশির দশকে সোনালি ব্যাঙ্কের ভল্ট খুলে এক বার রত্নগুলির হিসাব নেওয়ার জন্য সরকারি তৎপরতা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভল্টের প্রথম পাল্লাটি খোলার পরে আইনি এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির কারণে কাজ আর এগোয়নি।
আরও পড়ুন:
পাকিস্তানের সংবাদপত্র ‘দ্য ডন’-এ প্রকাশিত একটি খবরে দাবি মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার সোনালি ব্যাঙ্কের ভল্ট খুলে দরিয়া-ই-নূর এবং অন্য রত্নগুলির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে। প্রতিবেদনে নবাব পরিবারের বংশধর খাজা নইম মুরাদের মন্তব্যও ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি ঢাকার ‘আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে’ (একদা ঢাকার নবাবের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত প্রাসাদ) দরিয়া-ই-নূরকে প্রদর্শিত সামগ্রী হিসেবে রাখার সওয়াল করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত হিরেগুলির মধ্যে একটি। এর ইতিহাস কোহিনূরের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত।’’
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা ‘প্রেস ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ’-এর ডিরেক্টর জেনারেল ফারুক ওয়াসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সে দেশের সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’য় চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করেন। তাতে বলা বলা হয়েছে, সোনালি ব্যাঙ্কের ভল্ট খুলে দরিয়া-ই-নূর-সহ ১০৯টি রত্নের উপস্থিতি যাচাই করতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রকের সিনিয়র সচিব ও কমিটির সদস্য এএসএম সালেহ আহমেদ জানান, কমিটির সদস্যেরা বৈঠক করে ভল্টে থাকা প্যাকেট যাচাইয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করবেন। এর পর তাঁরা রত্নগুলি যাচাই করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ আশফাকের কথায়, ‘‘দরিয়া-ই-নূরকে অনেকে ‘অপয়া’ বলেও চিহ্নিত করেন। কারণ ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ওই হিরে হাতে আসার পর থেকেই মরাঠা ও শিখ সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছিল। ঢাকার নবাবদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করেছিল ‘কোহিনূরের সহোদর’কে কেনার পর থেকেই।’’ তিনি জানান, ঘটনাচক্রে দরিয়া-ই-নূর নামে আরও একটি হিরের অস্তিত্ব রয়েছে। সেটি একদা ইরানের শাহের কোষাগারে ছিল। বর্তমানে সে দেশেরই সরকারি ব্যাঙ্কের ভল্টে সংরক্ষিত রয়েছে।