ইরানে ক্ষমতার পালাবদলই তাঁর লক্ষ্য। ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ শুরুর চার দিনের মাথায় এ কথা স্পষ্ট করে দিলেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তবে প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজ়েকশিয়ান নন, তাঁর নিশানায় যে শিয়া মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই, সে বিষয়েও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
সত্তরের দশকের শেষপর্বে ইজ়রায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বিগিন ঘোষণা করেছিলেন, পশ্চিম এশিয়ার কোনও দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করলেই পত্রপাঠ সেই পরমাণু কেন্দ্রতে হামলা চালানো হবে। আশির দশকেও সেই ‘বিগিন ডকট্রিন’ অনুসরণ করে ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে ইজ়রায়েলি বিমানহানা হয়েছে। কিন্তু তেল আভিভের তৎকালীন শাসকবর্গ সরাসরি তেহরানে ক্ষমতার পালাবদলের বার্তা দেননি। এ বার যেমনটা দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
বস্তুত, তেহরানে ক্ষমতা বদলই যে তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য সে কথা স্পষ্ট করেছেন নেতানিয়াহু নিজেই। ইরানের জনতার উদ্দেশে ভিডিয়ো-বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘‘একটি দুষ্ট ও নিপীড়ক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আপনাদের আবেদন জানাচ্ছি।’’ সেই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ইজ়রায়েলের লড়াই ইরানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের লড়াই সেই খুনি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা আপানাদেরও নিপীড়ন করছে। মুক্তি পাওয়ার জন্য রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে আপনাদের সামনে।’’ এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নেটোভুক্ত ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের মদত ইজ়রায়েলের পিছনে রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও মার্কিন সরকারের দুই শীর্ষকর্তাকে উদ্ধৃত করে রবিবার সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইজ়রায়েল খামেনেইকে খুনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেললেও তাতে সায় দেননি ট্রাম্প।
১৯৭৯ সালের সেই ‘ইসলামি বিপ্লব’
তেল আভিভের এ বারের পরিকল্পনা সফল হলে প্রায় সাড়ে চার দশক পরে আবার ক্ষমতার পালাবদলের সাক্ষী হতে পারে তেহরান। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে ইরানে ‘গণবিপ্লব’ ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন খামেনেইয়ের পূর্বসূরি আয়াতোল্লা রুহুল্লা খোমেইনি। ইতিহাসে সেই পালাবদল ‘ইসলামি বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সেই গণবিপ্লবের জেরে ইরানে শাসক রেজা শাহ পাহলভির পতন ঘটেছিল। জনরোষের মুখে দেশ ছাড়তে হয় আমেরিকার এবং ইউরোপীয় দেশগুলির ঘনিষ্ঠ ওই রাজাকে। এর পরে ফ্রান্সে নির্বাসন থেকে ইরানে ফিরেছিলেন সেই গণবিপ্লবের নেতা রুহুল্লা।
রুহুল্লা অনুমোদিত নতুন দল ‘ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টি’ (আইআরপি) ১৯৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নতুন সরকার গঠনের পরে কার্যত রাতারাতি ইরানের রাষ্ট্রীয় চরিত্র বদলে গিয়েছিল। আমেরিকা, ইউরোপ, ইজ়রায়েল এমনকি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো সুন্নি রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, সে সময়ই পরমাণু কার্যকলাপও শুরু হয়েছিল ইরানে। শুরু হয়েছিল ইজ়রায়েলের তরফে প্রত্যাঘাত পর্বও।
ক্ষমতার উৎস খামেনেই
গত সাড়ে চার দশকের ইসলামি কট্টরপন্থী শাসনে ইরানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রবল ভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বারে বারেই। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি বা নারী স্বাধীনতার পক্ষের আন্দোলনকে দমন করা হয়েছে নির্মম ভাবে। অথচ ষাট এবং সত্তরের দশকে আফগানিস্তানের মতোই ইরানও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং নারী স্বাধীনতার জন্য পরিচিত ছিল। খাতায়-কলমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভা থাকলেও সে দেশে আসল ক্ষমতার উৎস খামেনেইয়ের নেতৃত্বাধীন ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’।
আরও পড়ুন:
আবার কি ইরানে শাহি শাসন?
ট্রাম্প-নেতানিয়াহু জুটি তেহরানে পালাবদল ঘটিয়ে আবার পাহলভি বংশের শাসন ফেরাতে চান বলে জল্পনা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। ক্ষমতাচ্যুত রেজা শাহ পাহলভি প্রয়াত হয়েছেন কয়েক দশক আগেই। তাঁর পুত্র ‘যুবরাজ’ রেজা শাহ আমেরিকায় বসবাস করেন। নিজেকে ইরানের বৈধ শাসক বলেও দাবি করেন তিনি। ইজ়রায়েলি হামলার পরে শনিবার বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘‘ইরানে খামেনেইয়ের শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটাই ক্ষমতা বদলের উপযুক্ত সময়।’’ ১৯২৫ সালে ইরানের রুশ ঘনিষ্ঠ শাসক আহমেদ শাহ কাজ়ারকে উৎখাত করে ব্রিটেন এবং আমেরিকা ক্ষমতায় বসিয়েছিল রেজার পিতামহ পাহলভি বংশের প্রথম শাসক আলি রেজা শাহকে। ১০০ বছরের মাথায় ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর সৌজন্যে কি আবার পাহলভি রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটবে ইরানে?