এক দিকে বালোচিস্তান, অন্য দিকে খাইবার পাখতুনখোয়া। বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এবং তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) বিদ্রোহীদের ধারাবাহিক হামলায় বিপর্যস্ত ইসলামাবাদ এ বার ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র কৌশল নিয়েছে। পাক সামরিক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এখন আফগানিস্তানে সক্রিয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএসকে) এবং লশকর-এ-ত্যায়বার মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলে বালোচ এবং টিটিপির মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
সম্প্রতি, আইএসকে নেতা মির শফিক মেঙ্গলের সঙ্গে লশকর কমান্ডার রানা মহম্মদ আশফাকের একটি ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ‘মৈত্রীর বার্তা’ হিসাবে মেঙ্গল একটি পিস্তল উপহার দিচ্ছেন রানাকে। উত্তর বালোচিস্তানে আইএসআই-এর তত্ত্বাবধানে তাঁদের দু’জনের বৈঠক হয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে দাবি। প্রসঙ্গত, ২০২১-এর ১৫ অগস্ট তালিবান আনুষ্ঠানিক ভাবে কাবুল পুনর্দখল করে। আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার তালিবানি শাসন কায়েম হওয়ার পরেই সে দেশে পাততাড়ি গুটোতে শুরু করে আমেরিকা। সর্বশেষ বিমানটি কাবুল বিমানবন্দর থেকে ছাড়ে ২০২১-এর অগস্টের শেষ পর্বে। সেই সময়ই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তির পরিচয় দিয়েছিল পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর আফগান শাখা আইএসকে। জাতি এবং বর্ণগত ভাবে বহুধাবিভক্ত আফগানভূমে আইএসকে (এলাকার পুরনো নাম খোরাসান থেকে) বরাবরই তালিবান বিরোধী। বস্তুত, তাদের উপর পাক সেনা বা আইএসআই-এর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
আফগান তালিবান বাহিনী ধারাবাহিক ভাবে অভিযান চালাচ্ছে আইএসকে-র বিরুদ্ধে। ঘটনাচক্রে, কাবুলের ক্ষমতা দখলের পরে গত সাড়ে চার বছরে তালিবানের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কের অনেকটাই অবনতি হয়েছে। পাক ঘনিষ্ঠ হক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান তথা আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হক্কানি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। উল্টোদিকে প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ হাসান আখুন্দ, উপপ্রধানমন্ত্রী আব্দুল গনি বরাদরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে নয়াদিল্লির। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি, এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান চাইছে লশকরের সঙ্গে আইএসকে-র সমঝোতার পথ প্রশস্ত করে আগামী দিনে বালোচ, টিটিপি-র মোকাবিলার পাশাপাশি জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসের অভিঘাত বাড়াতে। প্রসঙ্গত, মোল্লা মহম্মদ ওমরের জমানায় কাবুল একাধিক বার জম্মু ও কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদীদের প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে। কিন্তু ক্ষমতা পুনর্দখলের পর সে পথে তারা হাঁটেনি।
আরও পড়ুন:
গত কয়েক মাসে কাচ্চি বোলানে ট্রেন ছিনতাই, কোয়েটায় আধাসেনা ফ্রন্টিয়ার কোরের গাড়িতে আইইডি বিস্ফোরণ, নোশকিকে সেনা কনভয়ে আত্মঘাতী হামলার মতো নতুন কৌশলে হানাদারি চালিয়েছে বিএলএ। তাদের ফিদায়েঁ বাহিনী মজিদ ব্রিগেডই এই হামলাগুলি চালাচ্ছে বলে সেনার দাবি। ঘটনাচক্রে, মার্চ মাসের গোড়াতেই অন্য দুই সশস্ত্র বালোচ গোষ্ঠী, বালোচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) ও বালোচ রিপাবলিকান গার্ডস (বিআরজি) এবং সিন্ধুপ্রদেশে সক্রিয় বিদ্রোহী সংগঠন ‘সিন্ধুদেশ রেভলিউশনারি আর্মি’র (এসআরএ) সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন যৌথমঞ্চ গড়েছে বিএলএ। ইসলামাবাদের অভিযোগ, ভারতের তৎপরতাতেই একজোট হচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি।
অন্য দিকে, প্রায় দেড় দশক ধরে পাক সেনার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে টিটিপি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের সঙ্গে পাক সরকারের শান্তিবৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল। তার পর থেকেই অশান্ত খাইবার পাখতুনখোয়া। ধারাবাহিক ভাবে অভিযান চালিয়েও স্বাধীন পাশতুনিস্তান-পন্থী এই সশস্ত্র বাহিনীকে বাগে আনতে পারেনি ইসলামাবাদ। উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের কুররম জেলায় আফগান সীমান্তে বুধবারও টিটিপির হানায় এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং এক মেজর-সহ ১১ পাক সেনা নিহত হয়েছেন। আফগানিস্তানের শাসক তালিবানের একাংশ থেকে টিটিপি মদত পাচ্ছে বলে পাক সেনার অভিযোগ। বস্তুত, গত ডিসেম্বরে আফগানিস্তানের মাটিতে বিমানহানাও চালিয়েছিল পাক বায়ুসেনা। যা নিয়ে কাবুল-ইসলামাবাদ টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তানের সরকার এবং সেনা টিটিপি-কে ‘ফিতনা আল খোয়ারিজ়’ এবং বালোচ বিদ্রোহীদের ‘ফিতনা আল হিন্দুস্তান’ নামে চিহ্নিত করে।