দুই বন্ধু। এক জনের পরিণতি জেল এবং সেখানেই আত্মহত্যা! অন্য জনের পথ গিয়ে থেমেছে হোয়াইট হাউসে! প্রথম জন জেফ্রি এপস্টাইন এবং দ্বিতীয় জন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে দাবি, দু’জনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ এপস্টাইনের সঙ্গে ট্রাম্পের নাম জড়িয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, যা নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। একই সঙ্গে তাঁর প্রশাসনের তরফে এপস্টাইন ফাইলের কিছু অংশ প্রকাশের জন্য আবেদন জানানো হল নিউ ইয়র্কের আদালতে। ওই ফাইল নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে ট্রাম্প প্রশাসন অস্বস্তিতে।
যদিও কুখ্যাত যৌন অপরাধী এপস্টাইনের সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথা প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে একে অপরকে যে চিনতেন, তা মেনে নিয়েছেন!
অভিযোগ, আমেরিকান ধনকুবের এপস্টাইনের গোপন সাম্রাজ্য ছিল পিডো আইল্যান্ডে। ব্যক্তিগত বিমানে পৃথিবীবিখ্যাত অতিথিদের উড়িয়ে আনা হত দ্বীপের বুকে, বিলাসবহুল প্রাসাদে। বিমানের নাম ছিল ‘লোলিটা এক্সপ্রেস’। নাবালিকা আর শিশুদের দিয়ে ওই প্রাসাদে যৌনচক্র চালাত এপস্টাইন। অতিথিদের ‘বিশেষ মালিশ’ করে দিলে ২০০ ডলার করে দেওয়া হত প্রত্যেককে। নতুন মেয়ে জোগাড় করে আনতে পারলে মিলত আরও ইনাম। এ ছাড়া এপস্টাইনের ফ্লরিডার পাম বিচের বাড়িতেও নাবালিকাদের যৌনচক্র চলত। এমন নানা কুকীর্তির জন্য তাঁকে দু’বার কারাবাসও করতে হয়।
এপস্টাইনের বিলাসবহুল প্রাসাদে কর্মরত তৎকালীন এক ব্যক্তির মুখেও উঠে এসেছে এপস্টাইন এবং ট্রাম্পের ‘বন্ধুত্ব’-এর কথা। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমসে’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই প্রাসাদে অনেক বার ট্রাম্পকে দেখা গিয়েছে। সম্প্রতি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে দাবি, এপস্টাইনকে নগ্ন মহিলার ছবি এঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। ২০০৩ সালে এপস্টাইনের ৫০তম জন্মদিনে চিঠি লিখে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তিনি। টাইপরাইটারের মাধ্যমে লেখা শুভেচ্ছাবার্তায় বলা হয়েছিল, “শুভ জন্মদিন। তোমার প্রতিটা দিন যেন ভিন্ন অথচ দুর্দান্ত ভাবে গোপন হয়ে ওঠে।” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিঠিতে এক নগ্ন মহিলার ছবি এঁকেছিলেন ট্রাম্প। নীচে কেবল ডোনাল্ড শব্দটি লিখে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই নিয়ে আদালতে মানহানি মামলাও করেন ট্রাম্প।
দীর্ঘ দিন ধরে এপস্টাইন মামলা চলছে। তবে এই মামলায় এখনও পর্যন্ত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনও অন্যায়ের অভিযোগ আনা হয়নি। ট্রাম্প দাবি করেছেন, এপস্টাইন তরুণীদের যৌন নির্যাতন করতেন, সেই সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা ছিল না। এমনকি, ট্রাম্প ও এপস্টাইনের সম্পর্ক ‘অস্বীকার’ করেছে হোয়াইট হাউসও। ট্রাম্পের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছেন, ‘মার-আ-লাগো’ ক্লাব থেকে এপস্টাইনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
২০০৪ সালে দুই বন্ধুর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়! কিন্তু তাঁর আগে এপস্টাইন এবং ট্রাম্পের গলায় গলায় বন্ধুত্বের অনেক ‘প্রমাণ’ মিলেছে। আমেরিকার পাম সৈকতই দুই বন্ধুকে মিলিয়েছিল আবার ওই সৈকতে একটি জমিকে কেন্দ্র করে তাঁদের বিবাদ! দু’জনের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিল ছিল। দু’জনেই নিউ ইয়র্কের বাইরে ম্যানহাটন থেকে ব্যবসায় সফল হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে ‘মার-আ-লাগো’তে একটি বিলাসবহুল পার্টিতে ‘এনবিসি নিউজ়’-এর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিলেন এই দুই ধনকুবের। সেই ছবিতে ট্রাম্পকে তরুণীদের ভিড়ে নাচতেও দেখা গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, এপস্টাইনের সঙ্গে তাঁর একান্ত সাক্ষাতের ছবিও ক্যামেরাবন্দি হয়। যদিও এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। সেই সাক্ষাতের কয়েক মাস পরে নিজের রিসর্ট ‘মার-আ-লাগো’তে ‘ক্যালেন্ডার গার্ল’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন ট্রাম্প। সেই প্রতিযোগিতায় ট্রাম্প ছাড়া উপস্থিত ছিলেন এপস্টাইনও! ওই প্রতিযোগিতায় উপস্থিত ছিলেন ফ্লরিডার ব্যবসায়ী জর্জ হুরানি। ২০১৯ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ওই প্রতিযোগিতা নিয়ে মুখ খোলেন। তাঁর তৎকালীন বান্ধবী এবং ব্যবসায়িক অংশীদার জিল হার্থ পরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। তিনি অভিযোগ করেন, ট্রাম্প তাঁকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে জোর করে চুম্বন করেন! যদিও পরে হার্থ সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করেন। ১৯৯৭ সালে ম্যানহাটনে এক গোপন পার্টিতে আবার ট্রাম্প এবং এপস্টাইনকে এক সঙ্গে দেখা যায়।
আরও পড়ুন:
এপস্টাইনের ব্যক্তিগত বিমানে ট্রাম্পকে ঘোরাফেরা করতেও দেখা গিয়েছে বলে খবর বিভিন্ন প্রতিবেদনে। শুধু একা ট্রাম্প নন, এপস্টাইনের বোয়িং ৭২৭ বিমানে আরও অনেক নামকরা ব্যক্তি চড়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দশকে অন্তত সাত বার এপস্টাইনের ব্যক্তিগত বিমানে চেপেছেন ট্রাম্প! ২০০২ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, এপস্টাইন ‘দুর্দান্ত ব্যক্তি’। ট্রাম্পের কথায়, ‘‘তাঁর (এপস্টাইনের) সঙ্গে অনেক সুন্দর সময় কেটেছে। আমার মতো তিনিও সুন্দরী তরুণীদের পছন্দ করতেন।’’
তবে দু’জনের বন্ধুত্বের শেষের শুরু হয় ২০০৪ সালে। পাম সৈকতে একটি সম্পত্তি নিয়ে শুরু হয় এপস্টাইন এবং ট্রাম্পের বিরোধ। দুই বন্ধুই একটি সম্পত্তি কেনার জন্য ঝাঁপান। শেষ পর্যন্ত চার কোটি ডলারের বেশি মূল্যে কিনে নেন ট্রাম্প। তার পর থেকেই দু’জনের মধ্যে কথা কমে যায়।
২০০৮ সালে এপস্টাইনের বিরুদ্ধে নাবালিকা ধর্ষণ ও নিগ্রহের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। ২০১৯ সালের অগস্টে গ্রেফতারির মাসখানেকের মাথায় জেলেই আত্মহত্যা করে এপস্টাইন। তার বান্ধবী গিসলেন ম্যাক্সওয়েল শিশু ও নাবালিকাদের নিয়ে যৌন পাচারচক্র চালানোর দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২০ বছরের জন্য জেলে গিয়েছেন। এই ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন এপস্টাইনের হাতে নাবালিকা অবস্থায় নিগৃহীত ভার্জিনিয়া জিওফ্রে নামে এক মহিলা।