Advertisement
E-Paper

লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুনে ধ্বংস অসংখ্য রবীন্দ্র-স্মৃতি

দাবানল ড্রাগনের মুখের মতো ধ্বংস করল ৪০ হাজার একরেরও বেশি জমি এবং সেখানকার অন্তত ১২০০টি ভবন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল আমেরিকার মাটিতে বহু যত্নে আগলে রাখা এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ।

আমেরিকার মাটিতে বহু যত্নে আগলে রাখা এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ।

আমেরিকার মাটিতে বহু যত্নে আগলে রাখা এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ। —প্রতীকী চিত্র।

শুভশ্রী নন্দী

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৭
Share
Save

কথায় বলে, চোর যদিও বা কিছু রেখে যায়, আগুন কিন্তু ছেড়ে কথা বলে না। লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল ড্রাগনের মুখের মতো ধ্বংস করল ৪০ হাজার একরেরও বেশি জমি এবং সেখানকার অন্তত ১২০০টি ভবন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল আমেরিকার মাটিতে বহু যত্নে আগলে রাখা এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ।

সাতসাগর পারে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট দু’টি ছোঁয়া ছিল এ দেশের দুই প্রান্তে। অতলান্তিক মহাসাগর পারের পূর্ব আমেরিকায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ‍্যালয়ের গ্রন্থাগারে রয়েছে কবিগুরুর ‘গীতাঞ্জলি’-র মূল হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। আর প্রশান্ত মহাসাগর পারে, পশ্চিম আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে মদনগোপাল মুখোপাধ‍্যায়ের বাড়ির ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত লেখা, তাঁর বইয়ের প্রথম সংস্করণ ও রবীন্দ্র-চর্চার নানা নিদর্শন।

পেশায় ক্যানসার চিকিৎসক মদনগোপাল মুখোপাধ‍্যায় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আমেরিকার বাসিন্দা। তিনি যখন ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় পা দেন, এ দেশে কবিগুরুর বই বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড পাওয়া দুষ্কর ছিল। সমগ্র আমেরিকায় তখন গুটিকয় বাঙালি। তখন রবীন্দ্রনাথকে আরও কাছে পাওয়ার আর্তি থেকে শুরু হয় তাঁর রবীন্দ্রসংগ্রহের সুদীর্ঘ ৫৭ বছরের জীবনযাত্রাপথ। এ ব‍্যাপারে তিনি আমেরিকায় পথিকৃৎ। আমেরিকান সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে, নানা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ‍্যালয়ে ব‍্যাপক ভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়ার এক অনন‍্য দায়িত্বপালন তিনি করে চলেছেন এত বছর ধরে। লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর বাড়িতে ছিল অসংখ্য বাংলা বই, পাণ্ডুলিপি ও ছবি। দাবানলে বাড়ির সঙ্গে পুড়ে গিয়েছে সেই সব। চিরতরে হারিয়ে গেল কোন কোন অমূল্য সম্পদ? মদনগোপালবাবু টেলিফোনে জানালেন, আগুনে ধ্বংস হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সাক্ষরিত ‘দ‍্য হর্স’ নিবন্ধ যা লিপিকার ‘ঘোড়া’-র অনুবাদ। শিক্ষাবিদ মাইকেল সেডলার ১৯১৭-১৮ সালে যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের হাতে সই করে এই নিবন্ধটি উপহার দিয়েছিলেন। পুড়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা অপ্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা ও চিঠি এবং তাঁর লেখা ‘পার্সোনালিটি’ বইটির প্রথম সংস্করণের তাঁর সই করা একটি কপি। রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা পৌঁছনোর আগেই ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা ছিল সংগ্রহে। পুড়ে গিয়েছে সেগুলিও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট পাঁচ বার এসেছিলেন আমেরিকায় এবং ছিলেন মোট ১৭ মাস। সে সময়ে এ দেশে তিনি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এ দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুরনো বইয়ের সংগ্রাহক মদনমোহনবাবু রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’-সহ সমস্ত ইংরেজিতে লেখা বইগুলি নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন। তার মধ‍্যে ছিল অনেক ক’টির প্রথম সংস্করণ, কোনও কোনওটির মাত্র ২০০-২৫০ কপি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সব বইও পুড়ে যাওয়ায় কি ভেঙে পড়েছেন বর্ষীয়ান চিকিৎসক? তিনি বললেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেঁচে আছি, তাঁকে দিয়েই এই শোক সামলাচ্ছি। কবিগুরুর দেওয়া যে মন্ত্রগুলো আমাদের শান্তি দেয়, শোক মোকাবিলা ও উপশমে সেই গানগুলোতেই শান্তি খুঁজে নিচ্ছি।’’ আমেরিকা ছাড়া ইংল‍্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থেকে খুঁজে বহু রবীন্দ্র-স্বাক্ষরিত বই সংগ্রহ করেছিলেন মদনগোপালবাবু। যার মধ‍্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের ৭৫তম জন্মদিবসে প্রকাশিত দুষ্প্রাপ‍্য বই ‘গোল্ডেন বুক অব টেগোর’-এর প্রথম সংস্করণের একটি কপি। ছিল রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত ও স্বাক্ষরিত হাতে লেখা ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’ গানখানির ইংরেজি অনুবাদ।

আমেরিকাবাসী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘উত্তর আমেরিকায় রবীন্দ্র গবেষণার সম্ভার ছিল মদনবাবুর সংগ্রহশালা। আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রবাসে কাজ করছি, মদনদা এই কাজে পথিকৃৎ।’’ তবে সব হারিয়েও ভেঙে পড়ছেন না মদনগোপালবাবু। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেই বলছেন, ‘‘ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে, নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fire Rabindranath Tagore

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}