শেখ মুজিবুর রহমানের জেলা গোপালগঞ্জে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)-র সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষে গত কাল চার জন নিহত হয়েছিলেন। ঘটনার তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। গ্রেফতারও করা হয়েছে ২৫ জনকে। তবু গুলি কেন চলল এবং নিহতদের দেহ ময়না তদন্ত না করেই কেন পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হল, সেই প্রশ্ন উঠছে।
এ বিষয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিককে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সরাসরি কোনও জবাব দেননি। শুধু বলেছেন, “বিষয়টি আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসব। এ ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।” বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত অবশ্য কোনও মামলাও রুজু হয়নি। পুলিশের এক সূত্রের আবার দাবি, “উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চার জনের মরদেহ ময়না-তদন্ত করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়।” নিহতের আত্মীয়েরা সে কথা মানতে নারাজ।
কালকের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির পরে শহরে আজ সন্ধেবেলা পর্যন্ত কার্ফু জারি করা হয়েছিল। পরে সেই কার্ফুর মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানো হয়। আজ সকাল থেকে রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য, দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ। গোপালগঞ্জ সদর সার্কল পুলিশের এক শীর্ষকর্তার কথায়, “পরিস্থিতি থমথমে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।” তিনি জানান, সেনাবাহিনীর পরিচালনায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কাল সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন জখম হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে জখম ৯ জনের অবস্থা গুরুতর। আহতদের গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে। এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস জানিয়েছেন, চার জনের মৃতদেহ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতাল মৃত্যুর শংসাপত্রও দেয়নি।
গতকালের সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে ছিল ১৭ বছর বয়সি ইমন তালুকদার। জানা গিয়েছে, সে গোপালগঞ্জ শহরে একটি দোকানে কাজ করত। গন্ডগোলের আশঙ্কায় কাল বেলা ১১টার সময়ে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন দোকানের মালিক। কিন্তু ইমন বাড়ি না ফিরে সংঘর্ষস্থলে চলে যায়। আজ সকালে তার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে হাহাকার করছেন মা রোকসানা বেগম। তাঁর কথায়, “আমার ছেলেটাই সংসার চালাত। ওকে যে ভাবে মাটিতে ফেলে গুলি করে মেরেছে, আমি তার বিচার চাই।”
সেনা-পুলিশের কিন্তু দাবি, বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলায় কোনও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। সেনার তরফে বিবৃতি জারি করে আজ দাবি করা হয়েছে, ‘সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর উপরে বিপুল সংখ্যক ককটেল ও ইট পাটকেল ছুড়ে হামলা করে। সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথ ভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’
গোপালগঞ্জে অশান্তির পরে দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অডিয়ো বার্তায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন তিনি। হাসিনা বলেন, ‘‘যা আছে, তা নিয়েই এখন পথে নেমে পড়ুন। ঘরে বসে থাকার সময় আর নেই।’’ হাসিনা তাঁর অডিয়ো বার্তায় দাবি করেছেন, চার নয়, অন্তত সাত জন নিহত হয়েছেন। অন্য দিকে, এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আজ তাঁর ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘আমরা যুদ্ধের আহ্বান নিয়ে যাইনি। আমাদের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। মুজিববাদী সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিত ভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র হামলা চালায় আমাদের উপরে। যেরকমটা জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সব সময় একটা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়।’ পুরো ঘটনার ‘সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার’ দাবি করে নাহিদ বলেছেন, “দ্রুত বিচার না হলে আমরা আবার গোপালগঞ্জ আসব।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)