ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দাবি, গাজ়ায় কোনও দুর্ভিক্ষ হয়নি, সবটাই সংবাদমাধ্যমের একাংশের ‘প্রচার’। এত দিন ‘বন্ধু’ নেতানিয়াহুর সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বলতেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গোটা বিশ্বের তীব্র সমালোচনার মুখে এ বার মত বদলালেন তিনি। ট্রাম্পের একটি প্রতিনিধিদল পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গাজ়া ভূখণ্ড পরিদর্শনে গিয়েছেন। এই দলে রয়েছেন পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং ইজ়রায়েলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি। ইতিমধ্যেই গাজ়ায় পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়েছেন উইটকফ। কথা বলেছেন স্থানীয়দের সঙ্গে। ট্রাম্প এ দিন বলেন, ‘‘উইটকফের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন উনি। মূলত খাদ্যাভাব নিয়ে কথা হয়েছে। পরে বিশদে জানানো হবে।’’ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের আশ্বাস, দ্রুত এই পরিস্থিতির সমাধান করা হবে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সমর্থনপ্রাপ্ত সংস্থা ‘ইন্ট্রিগ্রেটেড ফুড সিকিয়োরিটি ফেজ় ক্ল্যাসিফিকেশন’ (আইপিসি)-এর বক্তব্য, দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে মর্মান্তিক ছবি এখন গাজ়া। চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে অপুষ্টি। এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝির মধ্যে ২০ হাজারেরও বেশি শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে ৩ হাজার চূড়ান্ত অপুষ্টির শিকার। পাঁচ বছর বয়সের নীচে শিশুদের অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে দ্রুত। ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী ১৬টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আইপিসি-র তথ্য অনুযায়ী গাজায় প্রতি তিন জনের এক জন খেতে পাচ্ছেন না। মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে চুড়ান্ত খাদ্যহীনতার এই সঙ্কট পরিবার-পিছু বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। উত্তর গাজ়ায় এর পরিমাণ ৩৩ থেকে ৮১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে তিন মাসের মধ্যে। প্রতি দশটির মধ্যে নয়টি পরিবার খাবার খুঁজে পাওয়ার নিত্যনতুন উপায় বেছে নিচ্ছেন। এমনকি আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটেও দু’টো খাবারের সন্ধান করছেন মানুষ।
এ ছাড়াও আছে অন্য সঙ্কট। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়ায় বেশিরভাগ মানুষ ঘরহারা, স্থানান্তরিত। অস্থায়ী শিবিরগুলোর তাঁবুতে দিন কাটছে। ইজ়রায়েল ও আমেরিকা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। তাদের ‘গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)-এর শিবিরে খাবার সংগ্রহ করতে এসে প্রাণ হারাচ্ছেন প্যালেস্টাইনিরা। মে মাস থেকে এ পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন ওই শিবিরে এসে। এই বৃহস্পতিবারই অন্তত ৯১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। কমপক্ষে ৬০০ জন লোক আহত। অভিযোগ, মানুষ বহু মাইল হেঁটে আসছেন খাদ্য সংগ্রহ করতে, মাঝপথে তাঁদের গুলি করে মারছে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী। যাঁরা খাবারের উপকরণ জোগাড় করতে পারছেন, তাঁদেরও রান্না করার উপায় নেই। জ্বালানি নেই। জল নেই।
ইজ়রায়েলে নিযুক্ত আমেরিকার দূত মাইক হাকাবি সম্প্রতি মন্তব্য করেন, জিএইচএফ নাকি দশ লক্ষ খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে। কিন্তু সেই খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিতে মারা যাচ্ছেন প্যালেস্টাইনিরা। তা ছাড়া রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, যে পরিমাণ খাদ্য গাজায় প্রয়োজন, তার কাছে ওই খাবার কিছু না। একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে হাকাবিকে নিয়ে গিয়েছিলেন উইটকফ। দেখা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। শুনেছেন তাঁদের অভিযোগ, বিপদের কথা। সামগ্রিক রিপোর্ট তৈরি করে জমা দেবেন ট্রাম্পের কাছে। উইটকফ প্রেসিডেন্টকে কী রিপোর্ট দেবেন, তার ওপর নির্ভর করছে ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপ। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাজার নাসের হাসপাতালে কর্মরত এক আমেরিকান চিকিৎসক অ্যাডামস এবং নার্স বুর্জোস আবেদন করছেন, উইটকফ যেন তাঁদের হাসপাতালে এসে, না খেতে পেয়ে কঙ্কালসার হয়ে যাওয়া শিশুদের দেখে যান। তাঁদের কথায়, ‘‘দেখে যান কী ভাবে মানুষকে জোর করে না খেতে দিয়ে একটা জাতিকে এবং তাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানুষ তৈরি করেছে এই পরিস্থিতি।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)