রক্তক্ষয়ী হিংসা এবং অভ্যুত্থানের পর নেপালের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান হলেন নেপালের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি তথা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সুশীলা কারকি। তিনিই ছিলেন জেন জ়ি-র তাস। কিছু সাংবিধানিক জটিলতা নিয়ে শেষ মুহূর্তের আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল জেন জ়ি-র একাধিক প্রতিনিধি, সেনাপ্রধান, প্রেসিডেন্ট এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সহমতের মাধ্যমে। দুর্নীতির প্রশ্নে আপসহীন হিসেবে পরিচিত কারকি আজই শপথ নিলেন। দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী তিনি।
কারকির শপথ এবং তার পরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এর ফলে নেপালে শান্তি ও সুস্থিতি ফিরবে।’ ঘনিষ্ঠ পড়শি হওয়ার সূত্রে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই নেপালের উন্নয়নের সঙ্গী এবং দু’দেশের মানুষের স্বার্থে একযোগে কাজ চালিয়ে যাবে— এ কথাও বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
সূত্রের খবর, নেপালের বর্তমান সরকার ভেঙে দিয়ে কয়েক মাসের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গড়া হবে। কাল ভোরের মধ্যেই একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠন হবে। প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই নেপালের বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। সূত্রের বক্তব্য, জেন জ়ির নেতা সুদান গুরুং সেনাপ্রধানকে আজ সকালে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি আজকের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী (কার্কি) নির্বাচিত না হন, তা হলে আবার অশান্ত করে তোলা হবে কাঠমান্ডুকে। তাতে যে কাজ হয়েছে, তা আজ রাতের ঘটনাক্রমই প্রমাণ করে দিল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
এই ঘটনাক্রমের ভিতরে নেই নয়াদিল্লি। থাকার গ্রাহ্য কারণও ছিল না। কিন্তু নেপালের রাজনৈতিক অলিন্দ বলছে, ঘটনাবলিতে শুধু নজর রাখাই নয়, বাংলাদেশের মতো যাতে মুখ না পোড়ে, সে কারণে নেপালের সেনাপ্রধানের সঙ্গে ‘ট্র্যাক টু’ আলোচনা চালিয়েছেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের শীর্ষ নেতৃত্ব। এমনও এখানে শোনা যাচ্ছে, আপাতত সুশীলা ভারতের পছন্দের প্রার্থী। কারণ, পদাধিকার বলেই কারকি বিভিন্ন দেশে ঘুরেছেন, ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে মধুর, এমনও জানিয়েছেন আগে ভিন্ন প্রসঙ্গে। কার্কির সঙ্গে কাজ করতে সমস্যা হবে না ভারতের। দেউবা বা ওলির মতো কারকি জাতীয়তাবাদের জিগিরও তোলেন না, পরিণত মাথায় আমলাতান্ত্রিক পথে হাঁটেন।
এখানকার সূত্রের বক্তব্য, গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমশ চিনের দিকে ঝুঁকেছেন কে পি ওলি, এবং নেপালের রাজনৈতিক নেতারা। লিপুলেখ, কালাপানিকে নেপালের মানচিত্রে এনে তাঁরা ভারতকে রক্তচক্ষু দেখিয়েছেন চিনের বরাভয়ে। ভারতের এখন বক্তব্য, যে সরকারই আসুক না নেপালে, সে ভারতের পরম মিত্র না হলেও, যেন শত্রু না হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে যে ভাবে ভারত-বিরোধিতা রাজনৈতিক ও অন্তর্বর্তী সরকারি স্তরেও (বর্তমান) চারিয়ে গিয়েছে, তা নেপালের সঙ্গে হলে মহা বিপদ নয়াদিল্লির। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলে থাকেন, ‘কাঠমান্ডু-নয়াদিল্লির সম্পর্ক রুটি-বেটির।’
তবে যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর নামটি ঘোষণা করতে গোটা দিন লাগল, তার কারণ সাংবিধানিক। নেপালের সংবিধান বলছে, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। আর জেন জ়ি বলেছে, বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থাকে ভেঙে, জরুরি অবস্থা জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হোক। ছ'মাস পরে যখন ফের সংসদীয় নির্বাচন হবে তখন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ হবে। কমিউনিস্ট, মাওবাদী, নেপাল কংগ্রেসের অবশ্য মত ছিল, এই সংসদ ভাঙা ঠিক হবে না। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, রাজনৈতিক দলগুলি এখনও অপেক্ষা করছে কয়েক বছরের মধ্যে নতুন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তারা আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে আসবে। তবে শেষ পর্যন্ত জেন জ়ির দাবিই বহাল থাকল।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলিকে উৎখাত করার নীল নকশা ছ'মাস আগে থেকেই নিঃশব্দে বোনা শুরু হয়েছিল দেশের তিনটি বিন্দু থেকে। উত্তপ্ত কাঠমান্ডুর রাজনৈতিক মহল বলছে, উনিশ-বিশ এই তিন শক্তিই অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়েছে জেন জ়িকে। এ বার সেই জেন জ়ির ঘাড়ে চড়েই যখন ধ্বংসলীলার মাধ্যমে পরিবর্তন এল, নেপালের রাজনীতির দাবার বোর্ড এবার নতুন খেলার জন্য প্রস্তত হচ্ছে।
যে তিনটি ক্ষমতাবিন্দু এই অভ্যুত্থান এবং 'পরিবর্তনকে' সম্ভব করল তার প্রথমেই রয়েছেন কাঠমান্ডুর নির্দল মেয়র বলেন্দ্র শাহ ওরফে বলেন। বয়স ৩৩, অসম্ভব জনপ্রিয় এই প্রাক্তন আন্ডারগ্রাউন্ড র্যাপার প্রতিষ্ঠান বিরোধী হিসাবেই বেড়ে উঠেছেন। তাঁর সমর্থন ছিল জেন জ়ির আন্দোলনের প্রতি, এবং জেন জ়ি-রও তিনিই চোখের মণি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম পছন্দ। মেয়র হিসেবে কাজ করতে শুরু করায়, কে পি ওলির বিষ নজরে পড়ে যান বলে অভিযোগ, এবং তখনই সরকার তাঁকে উত্যক্ত করতে শুরু করে। বারবার মামলায় ফাঁসায়। বলেন্দ্র সোশ্যাল মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এক দিন আমি সিংহদ্বার জ্বালিয়ে দেব।’ তখন থেকেই গোপনে তিনি জেন জ়ি-কে উদ্দীপিত করার কাজটি শুরু করেন। তবে এখন প্রধানমন্ত্রী তিনি হতে চান না, এই স্বল্প সময়ের জন্য। বক্তব্য, যেহেতু তিনি সাংসদ নন, তাই গায়ের জোরে প্রধানমন্ত্রী হবেন না। নতুন নির্বাচনে লড়ে সাংসদ হতে পারলে তার পর ভাববেন।
দ্বিতীয় বিন্দুটি সম্ভবত সবচেয়ে জোরালো। রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির নেতা রবি লামচানে। ২১ সাংসদের এই দলের নেতা হিসেবে তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও হয়েছেন। বলেন্দ্রর যেহেতু কোনও দল নেই, লামচানের দলেই ভিড় বেড়েছে মূল স্রোতের বিরোধী জনতা, জেন জ়ি-র। দেওবা, অলির সরকার তাঁকেও বারবার দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি করে বলে অভিযোগ। ৯ সেপ্টেম্বর জেন জ়ি কাঠমান্ডু উত্তাল করে তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু তিনিও প্রধানমন্ত্রী হতে নারাজ। জানিয়েছেন, মামলা লড়ে নতুন সরকারের আমলে দাগহীন হয়ে তবে প্রধানমন্ত্রিত্বের কথা ভাববেন। তিনিও জেলে যাওয়ার আগে হুমকি গিয়েছিলেন,‘আমায় আজ কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে। এক দিন আমি ওদের সবাইকে জেলবন্দি করব।’
তৃতীয় বিন্দুটি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বড় ব্যবসায়ী দুর্গা পরসাই। অভিযোগ, ওলি বা প্রচণ্ড এঁর থেকে নিয়মিত মোটা চাঁদা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বখেরা নিয়ে বিবাদ বাধে। পরসাইয়ের হাসপাতাল করা আটকে দেন ওলি, বিনিময়ে উৎকোচ দিতে অস্বীকার করেন পরসাই। তাঁর শিবিরের অভিযোগ, সরকার নানাভাবে উত্যক্ত করে তাঁকেও, গ্রেফতার করা হয়। পরসাই জেলে যাওয়ার আগে হুমকি দিয়ে যান ওলি সরকারকে, এবং জেন জ়ির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তবে তিনি কোনও ভাবেই প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী ছিলেন না। আরও এক নাম উঠে আসে আলোচনায়। আন্দোলনকারীদের একাংশ সুশীলাকে নন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে কুল মান ঘিসিংকে চেয়েছিল। নেপালে বিদ্যুতের দীর্ঘমেয়াদি ঘাটতি দূর করার নেপথ্যে নানা অবদান রয়েছে তাঁর। অবশ্য এই নাম ধোপে টেকেনি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)