পদযাত্রার ‘রেকর্ড’ বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তা সে ভারতে হোক বা চিনে! তবে সম্প্রতি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের এক ‘পদযাত্রার’ সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সে যাত্রা এক-দেড়শো কিলোমিটারের নয়, ২০ হাজার কিলোমিটারের। উত্তর এশিয়া থেকে জনগোষ্ঠী পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার একেবারে দক্ষিণতম বিন্দুতে! সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল লাইফ সায়েন্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং ‘এশিয়ান স্কুল অব দ্য এনভায়রনমেন্ট’-এর বিজ্ঞানীদের দাবি, প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এটিই ছিল দীর্ঘতম পরিযান।
‘সায়েন্স’ পত্রিকায় এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার ২২টি প্রতিষ্ঠানের ৪৮ জন গবেষক এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। ১৩৯টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ১৫৩৭ জন ব্যক্তির ডিএনএ সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে পরিযানের পথও বের করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা জানিয়েছে, একেবারে আদি পর্বে মানুষের পরিযান শুরু হয়েছিল আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকা থেকে তা চলে আসে উত্তর এশিয়ায়। সেখান থেকে যে পরিযান শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়েছে টিয়েরা দেল ফুয়েগোয় (বর্তমানে আর্জেন্টিনায় অবস্থিত)। এই টিয়েরা দেল ফুয়োগো-কে মানব পরিযানের শেষ সীমা বলে গণ্য করা হয়। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে যে জিনগত বৈচিত্র তৈরি হয়েছে তা থেকে মানুষ কী ভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ হয়েছে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, তাও দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
পরিযানের যে পথ বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন সেই অনুযায়ী, উত্তর এশিয়া থেকে পাড়ি দিয়ে আজ থেকে প্রায় ১৪ হাজার বছর আগে আদিম মানুষ দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে (পানামা এবং কলম্বিয়ার সংযোগস্থল) পৌঁছেছিল। এই জায়গা থেকে পরিযায়ী জনগোষ্ঠী চার ভাগে ভাগ হয়। একটি গোষ্ঠী আমাজ়ন অববাহিকায় রয়ে যায়। বাকি গোষ্ঠীগুলির সদস্যেরা শুষ্ক চাকো অঞ্চল এবং আন্দিজ পর্বত পেরিয়ে প্যাটাগনিয়া তুষারভূমির (হিমবাহ এলাকা) দিকে রওনা দেয়।
বিবর্তনের উপরে এই পরিযানের প্রভাবের কথাও বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এশিয়ান স্কুল অব দ্য এনভায়রনমেন্ট’-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর কিম লি হিম জানান, এই দীর্ঘ পরিযানের ফলে এই জনগোষ্ঠীর জিনগত বৈচিত্র কমিয়ে দিয়েছিল। তার ফলে রোগপ্রতিরোধ সংক্রান্ত জিনের বৈচিত্র কমেছিল। এই বৈচিত্র হ্রাসের ফলে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতাও তাঁদের কমেছিল। প্রসঙ্গত, ঔপনিবেশিক আমলে বহু ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় নাগরিকদের ‘আমদানি’ করা বিভিন্ন রোগে আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সহজে আক্রান্ত হতেন এবং অনেক সময়ই সেই রোগ মহামারির আকার নিত। এই গবেষণাপ্রকল্পের বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, কেন আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন সংক্রামক রোগে সহজে আক্রান্ত হতেন, তার ব্যাখ্যা এই জিনগত বিশ্লেষণ এবং পরিযানের ইতিহাস থেকে পাওয়া সম্ভব।
পরিযানের ফলে আদিম জনগোষ্ঠীর সদস্যেরা বিভিন্ন ভৌগোলিক এবং জলবায়ুগত দিক থেকে বৈচিত্রপূর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এই প্রকল্পে যুক্ত বিজ্ঞানী এলিনা গুসারেভার মতে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থাকার ফলে পরিবেশের বিভিন্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলেন জনগোষ্ঠীর সদস্যেরা।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, জিনোম সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ইউরোপীয়দের তুলনায় এশীয়দের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র বেশি। জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধু পরিযান নয়, কোন কোন জনগোষ্ঠীর শরীরে কী ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় এবং কাজ করে, তাও বোঝা সম্ভব। আগামী দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এই ধরনের গবেষণা উপযোগী হতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)