Advertisement
E-Paper

বাবা ছিল ছিঁচকে চোর, শ্রীলঙ্কা হামলার চক্রী হাশিমকে নিয়ে হাজারো অভিযোগ

গত ২১ এপ্রিল, ইস্টারের সকালে শ্রীলঙ্কায় আটটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। তাতে নারী, পুরুষ এবং শিশু মিলিয়ে ২৫০ জন প্রাণ হারান।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ২১:০৩
আইএস-এর পতাকার সামনে মহম্মদ হাশিম মহম্মদ জাহরান। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

আইএস-এর পতাকার সামনে মহম্মদ হাশিম মহম্মদ জাহরান। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

জঙ্গি হামলার ভয়াবহতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। তার মধ্যেই ফের ব্যর্থতার অভিযোগ সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। ইস্টারের সকালে হামলার মূল চক্রী হিসাবে ইতিমধ্যেই মহম্মদ হাশিম মহম্মদ জাহরানের নাম উঠে এসেছে। আত্মঘাতী হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সে দেশের গোয়েন্দারা। সেই সঙ্গে জানা গিয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরেই জিহাদি কাজকর্মে যুক্ত ছিল হাশিম। সোশ্যাল মিডিয়ায় নাশকতার হুমকিও দিয়েছে সে। এমনকি স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যেও তাকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে আগে ভাগে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশের পূর্বে উপকূলবর্তী শহর কট্টানকুড়িতে দু’কামরার বাড়িতে মা-বাবা ও চার ভাই বোনের সঙ্গে থাকত হাশিম। তারা বাবা ছিল পেশায় ফেরিওয়ালা। আবার ছিঁচকে চোর বলে দুর্নামও ছিল। সেই অবস্থাতেই বেড়ে ওঠা হাশিমের। তবে ছাত্র হিসাবে প্রচণ্ড মেধাবী ছিল সে। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। মাত্র ১২ বছর বয়সে জামিয়াতুল ফালাহ আরবি কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে অল্পদিনের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নজরে পড়ে যায় সে।

কিন্তু বুদ্ধিমত্তার জন্য যেমন সকলের নজর কেড়েছিল হাশিম, তেমনই একগুঁয়ে, গোঁড়া স্বভাব কারও নজর এড়ায়নি। এক দিকে তিন বছরের মধ্যে কোরান তটস্থ করে ফেলেছিল সে। তার পর নখদর্পণে এনে ফেলেছিল ইসলামি আইনও। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ততই অবাধ্য হয়ে উঠছিল সে। এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেও মতবিরোধ দেখা দেয় তার। উদারপন্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে সে। তার কলেজের প্রাক্তন সহ অধ্যক্ষ এসএম আলিয়ার জানান, “আমাদের পড়ানোর আদব কায়দা একেবারেই পছন্দ ছিল না ওর। আমরা যে ভাবে কোরান ব্যাখ্যা করতাম, তার ঘোর বিরোধী ছিল হাশিম। ওর বিশ্বাস ছিল কট্টর ইসলামে।”

এখনও পর্যন্ত হামলার ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। ছবি: ছবি এএফপি।

আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কায় আইএস জঙ্গিদের গোপন ডেরায় হানা সেনার, ছয় শিশু-সহ হত ১৫​

আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৫ সালে তাই কলেজ থেকে হাশিমকে বহিষ্কার করা হয় বলে জানান তিনি। এসএম আলিয়া বলেন, ‘‘শেষ বার বাবার সঙ্গে স্কুল থেকে বেরিয়ে দেখেছিলেন তাকে। তার প্রায় ১৪ বছর পর, সংবাদমাধ্যমে আত্মঘাতী জঙ্গি হাশিমকে দেখতে পেলেন।’’

কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ২০০৬ সালে দারুল আথার নামে একটি মসজিদে যোগ দেয় হাশিম। সেখানের ম্যানেজমেন্ট কমিটিতেও জায়গা পেয়ে যায় সে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেনি। অন্য সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তিনবছরের মধ্যেই মসজিদের চাকরিটি খোয়াতে হয় তাকে। দারুল আথারের ইমাম এমটিএম ফাওয়াজ জানান, কারও মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করত না হাশিম। নিজে থেকেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিত। এমনকি ধর্মীয় গোঁড়ামি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মহিলাদের চুরি ও কানের দুল পরা নিয়েও আপত্তি ছিল তার।

স্কুলে পড়ার সময় হাশিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মহমম্দ ইউসুফ মহম্মদ তৌফিকের। পরে হাশিমের অনুচরেও পরিণত হন তিনি। তিনি জানান, নিজের পছন্দ মতো কোরানের উল্লেখিত নির্দেশের ভুল অর্থ উদ্ধৃত করা বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল হাশিমের। তার জেরেই তিনমাসের জন্য ধর্মোপদেশ দেওয়া থেকে তাকে নিষিদ্ধ করে মসজিদ কমিটি। তার পরই রাগে সেখান থেকে চলে যায় সে। নিজের অনুগামীদের নিয়ে দল তৈরি করে। তাদের নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ধর্মীয় বক্তৃতা করত সে। নিজের মতো করে কোরান ব্যাখ্যা করে শোনাত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের। ২৩ বছর বয়সে ১৪ বছরের একটি কিশোরীকে হাশিম বিয়ে করে বলেও জানা গিয়েছে।

উদারপন্থী সুফি সাধকদের বিরুদ্ধেও একসময় হাশিম উঠে পড়ে লেগেছিল বলে জানিয়েছেন সুফি মসজিদগুলির দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংগঠনের সচিব সাহলান খলিল রহমান। তিনি জানান, ২০০৪ সালে কট্টানকুড়ির একটি সুফি মসজিদে গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৬ সালে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বেশ কিছু বাড়িতে। এমনকি তাদের এক নেতাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয় প্রকাশ্য। সুফি সাধকদের ধর্মান্তকরণের উদ্দেশ্যে মৌলবাদী ওয়াহাবিরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছিল বলে দাবি তাঁর। আর সেই সুযোগেই সুফি সাধকদের হেনস্থা করতে নেমে পড়ে হাশিম। সুফিদের প্রার্থনার সময় হলে সময় মাইক বাজিয়ে তাদের উদ্দেশে কটুক্তি করতে শুরু করে সে। এমনকি ২০১২ সালে নিজের আলাদা মসজিদও শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানো বলেও তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

হামলার পর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে দেশের সর্বত্র। ছবি: এএফপি।

আরও পড়ুন: মুসলমান ভেবে এক দল লোকের উপর গাড়ি চালিয়ে দিলেন এই ব্যক্তি!​

সোশ্যাল মিডিয়ারও অপব্যবহার করতে শুরু করে হাশিম। মুসলিম ছেলেমেয়েদর মগজধোলাই করতে অনলাইনে নানারকম ভিডিয়ো পোস্ট করতে শুরু করে সে। জিহাদের ডাক দেয়। হুমকি দেয় নাশকতারও। একট ভিডিয়োয় এমনও বলতে শোনা যায় তাকে যে, ‘‘এমন ঘটনা ঘটাব যে দেহাংশ খুঁজে বের করার সময়ও মিলবে না। আল্লাকে যারা অপমান করে তাদের নরকে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে ছাড়ব।’’

তার পরই গত ২১ এপ্রিল, ইস্টারের সকালে শ্রীলঙ্কায় তার নেতৃত্বে আটটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। তাতে নারী, পুরুষ এবং শিশু মিলিয়ে ২৫০ জন প্রাণ হারান। হামলাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশে ফেরত, উচ্চ শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের সন্তান বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম তাদের নেতৃত্বে থাকা মহম্মদ হাশিম মহম্মদ জাহরান। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একগুঁয়ে কিশোর থেকে তার মধ্য তিরিশের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার যাত্রা কিন্তু দেশের মধ্যেই, প্রশাসনের নাকের ডগায়।

Sri Lanka Sri Lanka Blasts Sri Lanka Blast Easter Sunday IS
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy