Advertisement
E-Paper

নিজের দেশেই এ বার মূর্তি বসছে ভগিনী নিবেদিতার

‘অপরাজিতা’ এখন থেকে স্থায়ী ভাবে থাকবেন। বেলফাস্ট থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে এই ছোট্ট শহরটির নাম ডুঙ্গানন। বহু পুরনো আলস্টার অঞ্চলে নদী-জঙ্গলে ঘেরা ছবির মতো এই শহরটিতে এলে মনে হয়, সময় বুঝি থমকে দাঁড়িয়ে এখানে।

সুচেতনা সরকার

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ২২:২০
ভগিনী নিবেদিতা।

ভগিনী নিবেদিতা।

‘অপরাজিতা’ এখন থেকে স্থায়ী ভাবে থাকবেন।

বেলফাস্ট থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে এই ছোট্ট শহরটির নাম ডুঙ্গানন। বহু পুরনো আলস্টার অঞ্চলে নদী-জঙ্গলে ঘেরা ছবির মতো এই শহরটিতে এলে মনে হয়, সময় বুঝি থমকে দাঁড়িয়ে এখানে। উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের কাউন্টি টাইরোনের এই প্রত্যন্ত গ্রামেই জন্ম হয়েছিল সিস্টার নিবেদিতার। কিন্তু, আইরিশ মানুষজনের কাছে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এত দিন পর ডুঙ্গানন ট্যুরিস্ট সেন্টারে তাঁর স্থায়ী বসবাস শুরু হবে এ বার। ১৫০তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে ভগিনী নিবেদিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ সকল ভারতীয়ের। মূর্তির নাম ‘অপরাজিতা’। আগামী ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের সকালে এই মূর্তির আবরণ উন্মোচন হবে।

আইরিশ পরিবারে মার্গারেটকে মার্গো বা মার্গট বলে ডাকা হয়। বিবেকানন্দের ভাবনায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া আইরিশ কন্যা মার্গারেট নোবল। যে বাড়িতে নিবেদিতার জন্ম সেটি এখন একটি পাউন্ড শপ। কিন্তু, সেই পুরনো বাড়ির দেওয়াল আজও রয়েছে। হাত ছোঁয়ালে এখনও জাদুমন্ত্রে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। জাহাজে চড়ে নিবেদিতা প্রথম বারের জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছেন— ডেকের উপর দাঁড়িয়ে মার্গো হাত নাড়ছেন, মাথার স্কার্ফ দিয়ে সযত্নে ঢেকে রেখেছেন চোখের জল— ফেলে যাচ্ছেন ভাই রিচমন্ড, বোন মে আর মা ইসাবেলাকে। তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল পরাধীন ভারত। স্বামীজির ব্রত সম্পূর্ণ করতে এমনই এক তেজস্বিনী দুর্গার প্রয়োজন ছিল।

এই ঘটনা নিয়ে নাটক লিখেছেন ডুঙ্গাননের আর এক ভূমিকন্যা, জিন ম্যাকগিনেস, এত দিন পরে আবার। ডুঙ্গাননের রেনফ্রিউ হলে অভিনীত হয় ‘অ্যাওয়েকেনিং অব এ নেশন’। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা জিন ম্যাকগিনেস আইরিশ ভাষায় লিখেছেন এই নাটকটি। কলোনিয়াল বাঙালি তথা ভারতীয়ের মনে কেমন করে স্বাধীনতার তিন রং এঁকে দিয়েছিলেন নিবেদিতা, তা নিয়েই এই নাটক। চারুকলা শিল্প, সাহিত্য, আধ্যাত্মিকতা এবং জাতীয়তাবাদ নিবেদিতার জীবনের এই চারটি দিকের কথা সম্পূর্ণ অজানা ছিল ডুঙ্গাননের তথা আয়ার্ল্যান্ডের মানুষদের। ২০১০ সালে জিনের নাটকের গ্রুপ ‘নোবেল থেস্পিয়ান্স’ এই নাটকের অভিনয় করে নানা জায়গায়। ডাবলিনের স্যামুয়েল বেকেট থিয়েটার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। স্যামুয়েল বেকেটও ডুঙ্গানন শহরেরই মানুষ। তাই সাধারণ মানুষের উৎসাহ সীমাহীন। এ ভাবে আয়ার্ল্যান্ডে জিন নিঃশব্দে আনলেন নিবেদিতা বিপ্লব।

কিন্তু, এত কিছু ঘটল কেমন করে?

আইরিশ অল্ডারম্যান মরিস হেয়েজ গিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানে দেখা হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তখন লেখা হচ্ছিল ‘সেই সময়’ উপন্যাসটি। মরিস যে আইরিশ, সে কথা শুনে লেখক তাঁকে নিবেদিতার কথা বলেন। জানান আয়ার্ল্যান্ডের এই ক্ষুদ্র জনপদটির কথাও। মরিস ফিরে এসে খুঁজতে থাকেন। এমনকী বাড়ি বাড়ি ঘুরেও জিজ্ঞাসা করেন কারওর মনে আছে কি না? অবশেষে কাউন্সিলের রেকর্ড খুঁজে কিছুটা হদিশ পান। বাকিটা ইতিহাস।


ডুঙ্গানন মিউজিয়াম

আলস্টার হিস্ট্রি সার্কেলের উদ্যোগে নিবেদিতার জন্মস্থানটি চিহ্নিত করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। প্রায় দেড়শো বছর পরে আয়ার্ল্যান্ডের এই গ্রামের শরীরেও এসেছে অবধারিত পরিবর্তন। তাই এত সহজ ছিল না, সেই কাজ। অবশেষে খোঁজ মিলল সেই জায়গার। ১৬ নম্বর স্কচ স্ট্রিটে এখন একটি পাউন্ডশপ। এখানেই জন্ম নিয়েছিল এক বিরল ইতিহাস! এই কিংবদন্তি নারীর কথা এত দিন বিস্মরণের অতলেই তলিয়ে গিয়েছিল। এই ব্লু প্ল্যাকের সঙ্গে সঙ্গে মার্গারেট নোবল স্থায়ী ভাবে থিতু হলেন আইরিশ মানুষজনের মনে।

ক্যারেন করিগান, যিনি নাটকে নিবেদিতার ভূমিকায় অভিনয় করেন, বললেন, ‘‘এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এমন এক জন অসাধারণ প্রতিভাময়ী নারীর কথা সারা পৃথিবীর মানুষ জানবে এটাই স্বপ্ন। তিনি শুধু আইরিশই নয় আমারই গ্রামের মেয়ে! ভাবা যায়?’’ অরবিন্দ ঘোষের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পল ডনাঘি। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করেছেন নিবেদিতা এবং অরবিন্দ ঘোষের লেখা বইপত্রও। ভারত এবং আয়ার্ল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের মিল আজও তাঁকে আপ্লুত করে।

সর্বস্ব ত্যাগ করার পরেও নিবেদিতাকে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু বহু দিনই কেউ দেননি। বাঙালি সমাজ, ভারতের মানুষ, ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বা পশ্চিম দুনিয়া— সকলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু স্বাভিমানী জাতীয়তাবাদী ডুঙ্গাননের মানুষ নিবেদিতার পতাকা হাতে দেরিতে হলেও পথে নেমেছে। এ ভাবে আজকের দিনে আইরিশ জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় চিন্তায় ভাবতে শুরু করল— শুধু ডুঙ্গানন শহরের সেই মেয়েটির নামেই— মার্গারেট নোবল যাঁর নাম!

অরবিন্দের জন্মদিন, ভারতের স্বাধীনতা দিবস আর আলো ঝলমল গ্রীষ্মের আয়ার্ল্যান্ডে নিবেদিতা বসবেন নিজের ঘরে।

(পুনঃপ্রকাশিত)

Bhagini Nivedita statue
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy