প্রাচীর ভেঙেছিল চব্বিশ বছর আগেই। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জয়োল্লাস এই প্রথম শুনতে পেল বিশ্ব। বুঝতে পারল, দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্বের মতো প্রতিপক্ষকে ‘ট্যাকল’ করে আজ আক্ষরিক অর্থেই জার্মানি ‘সুপার পাওয়ার’। রবিবারের জয় আসলে সেই সামগ্রিক ‘কামব্যাক’-এর অংশ। অন্তত তেমনই মনে করেন জার্মানরা।
ইতিহাস বলছে, সে ধারণা ভুল নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ভাঙন, তার পরের রাজনীতি এবং অর্থনীতি সব মিলিয়ে বিশ্ব মানচিত্র থেকে কী ভাবে যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল কান্ট, হেগেল, আইনস্টাইনের এই দেশ। কিন্তু ১৯৯০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে যাওয়ার পর ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন অনেকেই। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সে বছরই তৃতীয় বার বিশ্বকাপ জিতেছিল সাবেক পশ্চিম জার্মানি। জনতা আশা করতে শুরু করেছিল, এই জয় সংযুক্ত জার্মানিতে শুভ সময়ের বার্তা বয়ে আনল বুঝি!
বাস্তব ছবিটা সে রকম ছিল না। বরং আর্থিক ভাবে রুগ্ণ পূর্ব জার্মানির সমস্যা আপাত স্বচ্ছল পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে জুড়ে যাওয়ায় ব্যাহত হল সামগ্রিক বৃদ্ধি। এমনকী ২০০২-এ যখন ফাইনালে হেরে গেল জার্মানি, তখনও ইউরোপের রুগ্ণতম দেশের তালিকায় তার নাম উপরের দিকে।
কামব্যাক-এর চিত্রনাট্যটার শুরু এর পর থেকেই। আর্থিক বৃদ্ধি তো বটেই, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়েছিল জার্মান প্রশাসন। তারই অংশ ছিল ফুটবল। তিন বারের বিশ্বজয়ী যাতে ফের বিশ্বজয় করতে পারে তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। নানা অংশ থেকে তুলে আনা হয়েছিল প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের। সে সবেরই ফল মিলল রবিবার। ১৯৯০ সালের মতো শুধু শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে তৈরি বিশ্বজয়ী দল নয়, এ বার আক্ষরিক অর্থেই ঐক্যবদ্ধ জার্মানির দেখা মিলেছে দলে। তাতে রয়েছেন আদতে ঘানার বাসিন্দা জেরোম বোয়াতেং, তিউনিসিয়ার সামি খেদিরা, তুর্ক-জার্মান ওজিল।
এ সবই আসলে বিশ্ব রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির ফিরে আসার কাহিনি। ইউরোপ তথা বিশ্বের চতুর্থ-বৃহত্তম অর্থনীতির খেতাব পেয়েছে একসময়ের রুগ্ণ এই দেশ। ক্রয়ক্ষমতার বিচারে বিশ্বের পঞ্চম শক্তিশালী হওয়ার তকমাও মিলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্গত দেশগুলিতে ‘ইউরো’ মুদ্রার প্রচলনও হয়েছে কিছুটা জার্মানির দৌলতে। ইইউ বাদে এখন ন্যাটো, জি-এইট, জি-টোয়েন্টি, সব কিছুরই অন্যতম সদস্য এই দেশ। ক্ষমতা এতটাই যে চরবৃত্তির প্রশ্নে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও ঘোল খাইয়ে দিতে পারেন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল। ৩০% বেকারত্বের হার নিয়ে দু’দশক আগে যাত্রা শুরু করা জার্মানি যে বিশ্বজয় করবে তাতে আশ্চর্য কী?
‘নয়া’ জার্মানির শুধু ফুটবল বিশ্বকাপ-ই যা ছিল না। সে তকমাও দিয়ে দিল রবিবার। শেষ সাত-আট মিনিট তখন দুরুদুরু বক্ষে প্রহর গুনছে জার্মানি। পাছে গোল শোধ না করে দেয় আর্জেন্তিনা। সময় ফুরোতেই সমবেত উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল বার্লিন। কুরফুয়েরস্টেনডামের রাস্তায় তখন আতসবাজি, হর্নের শব্দ। ২৯ বছরের ক্রিস্টোফ নীৎশে বলেলেন, “এ উচ্ছ্বাস যাওয়ার নয়।”
চব্বিশ বছর আগে শুধু জোড়াই লেগেছিল দুই জার্মানি। রবিবার সে মিলনের সব চেয়ে বড় উৎসব হল মারাকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy