E-Paper

ইতিহাসের বিস্মৃতি থেকে ম্যাঞ্চেস্টারের মঞ্চে বাংলার মন্বন্তর

সম্প্রতি ম্যাঞ্চেস্টার মিউজ়িয়াম, দ্য ইউনিভার্সিটি অব ম্যাঞ্চেস্টারের ইতিহাস বিভাগ এবং ইম্পিরিয়াল ওয়ার মিউজ়িয়াম নর্থ-এর সহযোগিতায় আয়োজিত হল এক বিরল স্মরণসভা, যেটিকে ১৯৪৩-র মন্বন্তরের প্রথম আন্তর্জাতিক স্মৃতিচারণ বলে ভাবা যেতে পারে।

শুভশ্রী মুখোপাধ্য়ায়

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩০
মন্বন্তর-চিত্র।

মন্বন্তর-চিত্র। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ।

এক হাতা ফ্যানের জন্য মরিয়া লড়াই। রাস্তায় মৃতদেহের সারি, না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছে শিশু থেকে বৃদ্ধ, শহর থেকে গ্রামে। বাংলায় পঞ্চাশের (১৯৪৩) এই মন্বন্তর কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং যুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক নীতির ফল, মানুষের তৈরি করা এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ব্রিটিশ শাসকেরা সে সময়ে এই দুর্ভিক্ষের খবর চেপে দিতে সংবাদমাধ্যমে কঠোর সেন্সরশিপ চালু করেছিল। তবু ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স ১৯৪৩-এর ২২ অগস্ট কলকাতার রাস্তায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের হৃদয়বিদারক ছবি প্রকাশ করে সেই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে দেন। ১৯৪৪ সালে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের ‘দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা’ও সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বুকে খিদের আগুন নিয়ে যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ সে দিন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘প্রজা’। কিন্তু তাঁদের জন্য কোথাও আজও নেই কোনও স্মৃতিফলক। ইতিহাসের খাতায় তাঁরা যেন এক ‘ফুটনোট’।

সেই বিস্মৃতিকে ভাঙতেই মন্বন্তরের ৮২ বছর পরে ম্যাঞ্চেস্টারের এক নীরব সন্ধ্যা ইতিহাসকে নতুন করে প্রশ্ন করল। সম্প্রতি ম্যাঞ্চেস্টার মিউজ়িয়াম, দ্য ইউনিভার্সিটি অব ম্যাঞ্চেস্টারের ইতিহাস বিভাগ এবং ইম্পিরিয়াল ওয়ার মিউজ়িয়াম নর্থ-এর সহযোগিতায় আয়োজিত হল এক বিরল স্মরণসভা, যেটিকে ১৯৪৩-র মন্বন্তরের প্রথম আন্তর্জাতিক স্মৃতিচারণ বলে ভাবা যেতে পারে।

সে দিন মঞ্চে ছিলেন অনিন্দিতা ঘোষ, আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের গবেষক। তাঁর কথায়, “বাংলার মন্বন্তর কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল না, এটি ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতা ওঔপনিবেশিক নীতির নির্মম পরিণতি।” কিউরেটর নুসরাত আহমেদ মনে করিয়ে দিলেন যে, ইতিহাসের এই অধ্যায় সম্পর্কে ব্রিটেনের নীরবতা আজও বজায় আছে। সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা কবিতা পুরী, যাঁর বিবিসি পডকাস্ট ‘থ্রি মিলিয়ন’ এই দুর্ভিক্ষের অন্ধকারকে নতুন চোখে দেখিয়েছে, বললেন, “এই ক্ষুধার স্মৃতি শুধু একটি দেশের নয়, একটি সাম্রাজ্যের নৈতিক পরাজয়ের দলিল।”

মন্বন্তরের পটভূমিতে ছিল যুদ্ধকালীন ‘ডিনায়াল পলিসি’, অতি দ্রুত চাল রফতানি, দাম বৃদ্ধির লাগামহীনতা এবং ব্রিটিশ সরকারের নীতিগত উদাসীনতা। চার্চিলের আমলের বণ্টনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, গ্রামের বাজার শুকিয়ে যায়, আর মানুষের দেহে ক্ষুধার চিহ্ন লেখা হতে থাকে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়েরই শমীক পাল দেখিয়েছেন, কী ভাবে সে সময়ে কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তন, জমির মালিকানার রাজনীতি এবং যুদ্ধ অর্থনীতি মিলিয়ে দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে তোলা হয়েছিল।

সে দিন ম্যাঞ্চেস্টারের কানারিস প্রেক্ষাগৃহে ভারত, বাংলাদেশ, ব্রিটেন, তিন দেশের মানুষ জড়ো হন এই মর্মস্পর্শী স্মৃতির সামনে। এক জন প্রবীণ স্মরণ করলেন, “ক্ষুধার্তের সেই কান্না শুনলে যেন পৃথিবী থেমে যেত।” ম্যাঞ্চেস্টারের এই স্মরণসভা তাই শুধু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো নয়, এটি আধুনিক সমাজের আত্মসমালোচনাও বটে। ঔপনিবেশিক স্মৃতির প্রতিটি অন্ধকার কোণায় আলো ফেলা, ন্যায়বিচারের দাবি, এবং না খেতে পেয়ে মৃত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি এক নীরব প্রণাম।

পঞ্চাশের মন্বন্তরকে ‘ফুটনোট’ থেকে ইতিহাসের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Famine History

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy