Advertisement
E-Paper

বড় পরমাণু হামলার জন্য আদৌ তৈরি নয় আমেরিকা, রিপোর্ট বিজ্ঞানীদের

উত্তর কোরিয়া বা পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী অন্য কোনও দেশ আচমকা হাইড্রোজেন বা পরমাণু বোমা ফেললে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমেরিকার একটি বড় অংশ। মৃত্যু হতে পারে লক্ষ লক্ষ মানুষের।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৮ ১৫:৪০

বড় ধরনের পরমাণু হামলার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয় আমেরিকা

উত্তর কোরিয়া বা পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী অন্য কোনও দেশ আচমকা হাইড্রোজেন বা পরমাণু বোমা ফেললে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমেরিকার একটি বড় অংশ। মৃত্যু হতে পারে লক্ষ লক্ষ মানুষের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন ওয়াশিংটন, ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়া, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া ও আলেকজান্দ্রিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ।

বড় ধরনের পরমাণু হামলা ঠেকানো তো দূর অস্তই, বিস্ফোরণের পর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্সও যথেষ্টই অপ্রতুল মার্কিন মুলুকে।

আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিজ অফ সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন ও মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিওরিটি (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা) দফতরের এক বিশেষ বৈঠকে, ওয়াশিংটনে গত সপ্তাহে এই রিপোর্ট দিয়েছেন মার্কিন জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে কী কী করণীয়, তা জানিয়ে আগামী ডিসেম্বরে তাঁরা ট্রাম্প প্রশাসনকে সবিস্তার রিপোর্ট দেবেন বলে জানিয়েছেন।

‘নিউজ অ্যান্ড টেররিজম’ শীর্ষক সেই ফ্যাক্ট শিটে (রিপোর্ট) বলা হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বড় ধরনের পরমাণু হামলা ঠেকানোর আর কোনও প্রস্তুতি নেয়নি আমেরিকা। তার জন্য মার্কিন বাজেটে অর্থবরাদ্দ করা তো দূরের কথা, তা ৫০ শতাংশেরও বেশি কাটছাঁট করা হয়েছে।

মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিওরিটি দফতরের আয়োজনে ওই বৈঠকে আমন্ত্রিত বক্তা জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী অমর্ত্য চট্টোপাধ্যায় ও অরুণ শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘‘আমেরিকার নজর এখন সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায়। যারা বড়জোর ১ কিলো টন (১ হাজার টন) ওজনের পরমাণু বোমা বানাতে পারে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের হাতে যে ধরনের পরমাণু বোমা বানানোর প্রযুক্তি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকটির ওজন খুব কম হলে, হতে পারে ১৮০ কিলো টন। সেগুলি ফেলা হলে, তার জেরে যে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, তা সামলানোর মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত আমেরিকার হাতে নেই।’’

গত সপ্তাহের বৈঠকে পেশ করা হয়েছে যে ফ্যাক্ট শিট

বৈঠকে প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ টেনের ভিনিমা ও আথেন্সের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী কাম ডালাস।

অমর্ত্য জানাচ্ছেন, যে ধরনের পরমাণু বোমার হামলা ঠেকানোর ব্যবস্থা রয়েছে এখন মার্কিন মুলুকে, তা ওজনে খুবই হাল্কা। ওই বোমাগুলিকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় পরমাণু বোমা বলাও যায় না। আদতে এদের নাম- ‘ডার্টি বম্ব’ বা, ‘রেডিওলজিক্যাল ডিজপার্সাল ডিভাইস’ (আরডিডি)। এগুলি আকাশ থেকে কয়েকটি প্রচলিত (কনভেনশনাল) তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে দিতে পারে। তার বেশি ক্ষমতা নেই ওই ডার্টি বম্বের।

আরও পড়ুন- হিরোশিমায় বোমা পড়েছে, ছুটিতে বসে শুনলেন আইনস্টাইন​

অরুণ শ্রীবাস্তবের কথায়, ‘‘উত্তর কোরিয়ার মতো পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী দেশগুলির হাতে যে বোমাগুলি রয়েছে সেগুলি হাইড্রোজেন বা খুব শক্তিশালী পরমাণু বোমা। তা পড়লে ক্ষয়ক্ষতি হবে অনেক বেশি পরিমাণে। আর তার ক্ষত থেকে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। সেই ক্ষয়ক্ষতি সামলানোর মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই আমেরিকার।’’

খুব শক্তিশালী পরমাণু বোমা পড়লে কী কী হয়?

প্রথমত, আকাশেই তৈরি হয় অগ্নিগোলক (ফায়ারবল)। যার তাপমাত্রা পৌঁছয় কয়েক লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

দ্বিতীয়ত, বায়ুমণ্ডল ও ভূপৃষ্ঠে হয় সুতীব্র আলোড়ন (শক ওয়েভস)। তৈরি হয় এক ধরনের মেঘ। মাশরুম ক্লাউড। অগ্নিগোলকের ভেতরে থাকা পদার্থ বাষ্পীভূত হলেই জন্মায় ওই মেঘ। মেঘ ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকে। পরে নিউক্লিয়ার ডিভাইস থেকে সেই মেঘে ঢুকে পড়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ। সেই বাষ্পীভূত তেজস্ক্রিয় পদার্থ ঠান্ডা হলে কঠিন হয়। আর মাটিতে নামতে শুরু করে। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। হাওয়ার জোরে তা মাটিতে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত, বাতাসে আধানযুক্ত কণা (চার্জড পার্টিক্‌ল বা আয়ন)-র প্রাচুর্যে মাটির গভীর পর্যন্ত শক্তিশালী বিদ্যুৎ (ইলেকট্রিক কারেন্ট) প্রবাহ হয়। ফলে, তড়িদাহত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।

আর ‘ডার্টি বম্ব’ পড়লে কী কী হয়?

এক, যে এলাকার ওপর ডার্টি বম্ব পড়ে, সেখানে ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ।

দুই, সেই তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলি ভেঙে যায় গামা ও এক্স-রে’তে। তার সঙ্গে হয় আলফা ও বিটা রশ্মির বিকিরণ।

তিন, গামা ও এক্স-রে বাতাসে দ্রুত পৌঁছয় অনেক দূরে। শরীরের ভেতর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সহজে ঢুকে যেতে পারে গামা ও এক্স-রে। খাবার, শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলেও তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়।

চার, বিটা রশ্মির বিকিরণ বাতাসে কয়েক গজের বেশি দূর যেতে না পারলেও, চামড়ার খুব ক্ষতি করে।

পাঁচ, আলফা রশ্মির বিকিরণ বাতাসে দু’-এক ইঞ্চির বেশি দূরে যেতে পারে না। আলফা রশ্মির বিকিরণ চামড়ার ভেতরেও ঢুকতে পারে না। তবে শ্বাস, খাবারের সঙ্গে মিশে গেলে অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে আলফা রশ্মির বিকিরণ।

বৈঠকে কী কী বলছেন দুই ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিজ্ঞানী অমর্ত্য ও অরুণ?

দু’জনেই জানিয়েছেন, বোমার ওজন এক কিলো টন বা তার কিছু বেশি হলে শকওয়েভের মাত্রা হতে পারে ০.২ রিখটার। তাপ ও আকাশে প্রাথমিক বিকিরণের পরিমাণ হতে পারে যথাক্রমে ০.৪ এবং ০.৫ র‌্যাড। আর মাটিতে নেমে আসার পর সেই বিকিরণের মাত্রা পৌঁছতে পারে ৩.৪ র‌্যাড পর্যন্ত।

আরও পড়ুন- ইরানের সঙ্গে ছয় দেশের চুক্তি নিয়ে জল্পনা​

কিন্তু বোমার ওজন যদি ১০ কিলো টন বা তার বেশি হয়, তা হলে শকওয়েভের মাত্রা হতে পারে ০.৪ রিখটার। সে ক্ষেত্রে তাপ ও আকাশে প্রাথমিক বিকিরণের পরিমাণ হতে পারে যথাক্রমে ১.১ এবং ০.৮ র‌্যাড। মাটিতে নেমে আসার পর সেই বিকিরণের মাত্রা পৌঁছে যেতে পারে ৬ র‌্যাড পর্যন্ত।

কতটা এলাকা জুড়ে ছড়ায় মাশরুম ক্লাউড?

অমর্ত্য বলছেন, ‘‘খুব শক্তিশালী বোমা পড়লে আকাশেই তার মাশরুম ক্লাউড ছড়িয়ে পড়ে যতটা এলাকা জুড়ে, তার ব্যাসার্ধ (এয়ার-ব্লাস্ট রেডিয়াস) হয় ৩.৭ কিলোমিটারেরও বেশি। যে অগ্নিগোলকটা তৈরি হয় তার ব্যাসার্ধ হয় ৪৫০ মিটার। আর সেই অগ্নিগোলক থেকে যে বিকিরণ বেরিয়ে আসে তার ব্যাসার্ধ হয় এক কিলোমিটার। আর তার ফলে বাতাস ও ভূপৃষ্ঠে তাপ-বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে যতটা এলাকা জুড়ে, তার ব্যাসার্ধ হয় ৫.২৬ কিলোমিটারের কিছু বেশি।’’

পরমাণু হামলার পর চিকিৎসার হালহকিকৎ মার্কিন মুলুকে

অরুণের কথায়, ‘‘বৈঠকে বলেছি, অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ থেকে বাঁচানোর ওষুধের ব্যবহারও জানেন না আমেরিকার ৫০ শতাংশেরও বেশি চিকিৎসক ও নার্স। এ ব্যাপারে তাঁদের কোনও প্রশিক্ষণই দেওয়া হয়নি। একই অবস্থা জাপানেও।’’

অমর্ত্য বলছেন, ‘‘যাঁরা সেই চিকিৎসা জানেন, তাঁদের প্রায় কেউই যেতে চান না পরমাণু বোমা পড়ার জায়গা বা তার আশপাশের এলাকাগুলিতে, প্রাণের ভয়ে! একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের ৩৩ শতাংশই বলছেন, তাঁরা যেতে চান না ওই সব এলাকায়।’’

নেই পোড়ার পর্যাপ্ত চিকিৎসা, চামড়া প্রতিস্থাপন ব্যবস্থাও

আনন্দবাজারের প্রশ্নের জবাবে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ টেনের ভিনিমা ও আথেন্সের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী কাম ডালাস ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘গোটা আমেরিকায় বার্ন সার্জেনের সংখ্যা ৩০০-র বেশি নয়। পরমাণু বোমা পড়ার পর আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন পড়ে চামড়া প্রতিস্থাপনের। ডোনার স্কিন খুবই দুর্লভ। চামড়া প্রতিস্থাপনের পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই আমেরিকায়।’’

কোন কোন কাজে ব্যবহৃত হয় তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলি?

অরুণ ও অমর্ত্য জানাচ্ছেন, যেগুলি গামা রশ্মি বিকিরণ করে সেই কোবাল্ট-৬০ কাজে লাগে ক্যানসার চিকিৎসা, শিল্পে রেডিওগ্রাফি ও খাদ্যকে তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত করতে। সিজিয়াম-১৩৭ দিয়েও কোবাল্ট-৬০-র কাজ করানো যায়। লাগে গভীর কুয়ো খুঁড়তেও। ইরিডিয়াম-১৯২ কাজে লাগে শিল্পে রেডিওগ্রাফি ও ক্যানসার চিকিৎসায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনে।

আর যেগুলি বিটা রশ্মি বিকিরণ করে সেই স্ট্রনশিয়াম-৯০ কাজে লাগে রেডিও আইসোটোপ দিয়ে চালানো থার্মো-ইলেকট্রিক জেনারেটরে। যা প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা মেটায়।

যেগুলি আলফা রশ্মি বিকিরণ করে সেই প্লুটোনিয়াম-২৩৮ কাজে লাগে গবেষণা, গভীর কুয়ো খনন ও থার্মো-ইলেকট্রিক জেনারেটরে। আমেরিসিয়াম-২৪১ কাজে লাগে ভারী শিল্পে, গভীর কুয়ো খননে।

ডিসেম্বরের বিশদ রিপোর্টের অপেক্ষায় বিজ্ঞানী মহল, ট্রাম্প প্রশাসন

তবে বিজ্ঞানীদের একাংশ এখনই হতাশ হয়ে পড়তে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য, সোভিয়েতের পতনের পর পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের আন্তর্জাতিক চাপে এ ব্যাপারে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাজেটে অনেক কাটছাঁট হয়েছে ঠিকই, তবে বড় পরমাণু হামলা মোকাবিলার ব্যবস্থা আমেরিকায় নেই, এটাও বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। সেই ব্যবস্থা হয়তো পর্যাপ্ত নয়। তাই আগামী ডিসেম্বরে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা কী রিপোর্ট দেন, এখন তারই অপেক্ষায় রয়েছেন বিজ্ঞানী মহল। এবং অবশ্যই অপেক্ষায় রয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসাসনও।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক-তথ্য সৌজন্যে: আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিজ অফ সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন ও মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিওরিটি দফতর

ছবি সৌজন্যে: আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিজ অফ সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন

Major Nuclear Attack US Department Of Homeland Security Dirty Bomb পরমাণু বোমা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy