গত এক বছরে বিনিয়োগের বাজারে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সেগুলি মাথায় রেখে নিতে হচ্ছে লগ্নির সিদ্ধান্ত। সেটা না করতে পারলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সবার সুবিধার কথা মাথায় রেখে আজ সেই পরিবর্তনগুলিতে চোখ বুলিয়ে নেব। বুঝে নেব কোন পথে হাঁটলে আমাদের লাভ হতে পারে।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি চড়ছিল। বছরখানের হল সেখান থেকে তা নামতে শুরু করেছে। ভারতে খুচরো বাজারের মূল্যবৃদ্ধি নেমে এসেছে প্রায় তলানিতে (১.৫৪%)। যা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের লক্ষ্যমাত্রার (৪%, তার ২% কম-বেশি) চেয়েও নীচে। জিনিসপত্রের দাম কমতে থাকায় বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক ঋণের সুদ কমাতে শুরু করেছে। যাতে কম খরচে ঋণ পায় শিল্প সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ। কিন্তু এর পাশাপাশি, আমানতের সুদও কমিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি। আমাদের দেশে গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে তিন দফায় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক মোট ১০০ বেসিস পয়েন্ট রেপো রেট (যে হারে তারা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ধার দেয়) কমিয়েছে। সেই হার এখন ৫.৫%। এতে ঋণে সুদ যেমন কমেছে, তেমনই ৮০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত সুদ কমেছে বিভিন্ন জমা প্রকল্পেও। ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিও (এনবিএফসি) সুদ কমিয়েছে অনেকটা।
সম্প্রতি বহু পণ্যের জিএসটি কমায় জিনিসপত্রের দাম আপাতত কমের দিকেই থাকার সম্ভাবনা। মূল্যবৃদ্ধির এই হার যদি ধরে রাখা যায়, তা হলে চলতি অর্থবর্ষেই আরও এক দফা সুদ কমানো হতে পারে। তাতে ঋণের সুদ যেমন কমবে, সঙ্গে সমস্যাও বাড়বে সুদ নির্ভর মানুষের। আমানতের সুদ কমতে থাকায় অনেকে তহবিলের একাংশ মিউচুয়াল ফান্ড-সহ অন্যত্র সরাচ্ছেন। পরিস্থিতির বিচারে আপাতত কোনও প্রকল্পে সুদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। অতিমারি পরবর্তী সময়ে ব্যাঙ্ক জমায় সর্বোচ্চ সুদের হার ৬ শতাংশেরও নীচে নেমে গিয়েছিল। সেই হিসাবে দেখতে গেলে সম্প্রতি কমার পরেও এখন ব্যাঙ্ক জমায় যে সুদ পাওয়া যাচ্ছে তাকে আগামী দিনে ভাল মনে হতে পারে।
ব্যাঙ্কের সুদ এতটা নামলেও ডাকঘরের স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ কিন্তু এখনও কমানো হয়নি। ফলে ব্যাঙ্কের তুলনায় সে সব প্রকল্পে এখনও মোটামুটি ১০০ বেসিস পয়েন্ট বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। যেমন জাতীয় সঞ্চয়পত্রে ৭.৭%, সিনিয়র সিটিজ়েন্স প্রকল্পে ৮.২%। তবে বিহারের নির্বাচনের পরে জানুয়ারি থেকে সেগুলিতেও সুদ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। সুদ এক জায়গায় আছে ভারত সরকারের ফ্লোটিং রেট বন্ডেও (৮.০৫%)। তবে এনএসসি-তে সুদ কমলে সরকারি বন্ডেও একই মাত্রায় তা কমবে। নতুন প্রজন্মের কয়েকটি ছোট ব্যাঙ্ক বড়দের তুলনায় কিছুটা বেশি সুদ দেয়। সুরক্ষা নিয়ে চিন্তা থাকলেও সেগুলিতে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাখাই যায়। ওই সীমা পর্যন্ত আমানত বিমাকৃত।
গত বাজেটে করবিহীন আয়ের ঊর্ধ্বসীমা অনেকটা বাড়নো হয়েছে। জিএসটি কমেছে বহু পণ্যে। ফলে মানুষের হাতে লগ্নিযোগ্য তহবিল বেশি থাকবে। এক দিকে ঋণের সুদ এবং অন্য দিকে জিএসটি কমায় অনেকে গাড়ি, বাতানুকূল যন্ত্র ইত্যাদি কেনায় উৎসাহিত হতে পারেন। যে কারণে উৎসবের মরসুমে গাড়ির চাহিদা ছিল চোখে পড়ার মত। অক্টোবরে গাড়ি বিক্রি বৃদ্ধির হার ১৭% ছাপিয়ে নতুন নজির গড়েছে। লগ্নি বেড়েছে মিউচুয়াল ফান্ডেও। বাজারে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও প্রতি মাসে মোটা লগ্নি আসছে এসআইপি-রপথ ধরে।
আয়করের নতুন নিয়মে এখন বছরে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দিতে হবে না। ফলে ৭-১২ লক্ষ টাকা আয়ের বহু মানুষ করের বৃত্ত থেকে বার হয়ে যাবেন। ব্যাঙ্কের সুদ কমলেও কর সাশ্রয়ের কারণে এঁদের খুব একটা লোকসান হবে না।
গত কয়েক মাসে সোনা ও রুপোর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ফলে ভাল রিটার্ন দিচ্ছে গোল্ড এবং সিলভার ইটিএফ। ভাল বেড়েছে মাল্টি অ্যাসেট ফান্ডগুলিও। উৎসবের মরসুমের পরে এই দুই প্রিয় ধাতুর দাম কিছুটা কমলেও বড় মেয়াদে তা ফের উপরে উঠতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়লে এদের দাম বাড়ে, কমলে কমে। শুল্কের ব্যাপারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চিন-সহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতায় আসায় অনিশ্চয়তা কিছুটা কমেছে। ভারতের সঙ্গেও যদি আমেরিকার চুক্তি হয় এবং শুল্ক কমে তবে এ দেশের শেয়ার বাজার ভাল রকম শক্তি ফিরে পাবে। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি লগ্নি টানবে মিউচুয়াল ফান্ড।
(মতামত ব্যক্তিগত)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)