Advertisement
E-Paper

স্টেট ব্যাঙ্কের বেনজির লোকসান, প্রভাব ফেলতে পারে আমার আপনার পকেটেও

এসবি ই-এর নীরব মোদীর সঙ্গে কোন সংযোগ নেই। তা হলে কেন হল এই বিশাল ব্যাঙ্কের খাতায় এই বিশাল পরিমাণের ফুটো? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে তিনটি শব্দের মধ্যে, 'নন পারফরমিং অ্যাসেট' বা এমন ঋণ/লোন যা ব্যাঙ্ক ফেরত পাবে বলে আশা করে না।

কুমার শঙ্কর রায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ১৮:৪৭
ব্যাঙ্কের ইতিহাসে এত বড় পরিমাণের ক্ষতির নজির নেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ব্যাঙ্কের ইতিহাসে এত বড় পরিমাণের ক্ষতির নজির নেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নীরব মোদী প্রতারণা-কাণ্ডের ফলে পঞ্জাব ন্যাশান্যাল ব্যাঙ্ককে ইতিমধ্যেই ১৩,০০০ কোটি টাকার লোকসান বহন করতে হয়েছে। এই খারাপ খবর আমরা কিছুদিন আগেই পেয়েছি। কিন্তু মঙ্গলবার পেলাম আর এক অমঙ্গলজনক খবর। ভারতের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক এস বি আই (স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া) জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০১৮-র সময়ের মধ্যে ৭,৭৮০ কোটি টাকা লোকসান দেখিয়েছে। ব্যাঙ্কের ইতিহাসে এত বড় পরিমাণের ক্ষতির নজির নেই।

ভাবুন একবার। এসবি ই-এর নীরব মোদীর সঙ্গে কোন সংযোগ নেই। তা হলে কেন হল এই বিশাল ব্যাঙ্কের খাতায় এই বিশাল পরিমাণের ফুটো? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে তিনটি শব্দের মধ্যে, 'নন পারফরমিং অ্যাসেট' বা এমন ঋণ/লোন যা ব্যাঙ্ক ফেরত পাবে বলে আশা করে না। আসুন দেখা যাক, কিছু অকর্মণ্য ব্যাঙ্কের এই বিশাল লোকসানের কী কী ফল হতে পারে আমাদের টাকার উপর।

কয়েক বছর ধরেই ফিসফিস করে কথাটা উঠছিল। কিন্তু তখন কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। নতুন সরকার, নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন... এতেই মেতে ছিলেন সবাই। উইপোকার মতন ভিতর থেকে ক্ষতি করছিল 'নন পারফরমিং অ্যাসেট'। ব্যাঙ্ক পরিচালকবর্গ কী করছিলেন জানি না। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে নাকে তেল ঢেলে ঘুমচ্ছিলেন এবং স্বপ্ন দেখছিলেন বোধহয়! বড়, মাঝারি এবং ছোট শিল্পপতিরা এক এক করে ঋণের টাকা ফেরত দেওয়াতে প্রথমে দেরি করলেন। তারপর, আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি। এর পর বোঝা গেল, টাকা ফেরত দিতে পারবেন না। ঋণগ্রহকারীরা যখন একটি ঋণের সুদ বা মূল পরিশোধ করা বন্ধ করে, ঋণদাতা অর্থাৎ ব্যাঙ্ক টাকা হারাবে। এই ক্ষতি ব্যাঙ্ককে তাঁর শেয়ার হোল্ডার বা ভাগীদারকে জানাতে হয়। ৯০ দিন ধরে ঋণের আসল বা সুদ কোনওটাই না দিলে, নন পারফর্মিং অ্যাসেট (এনপিএ) হয়।

আরও পড়ুন়
১০ দিনে ৯ বার, ফের বাড়ল তেলের দাম, নয়া রেকর্ড ডিজেলে

যখন হাজার, লাখ, কোটি কোটি টাকা ঋণ ফেরত দেওয়া হয় না, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর লোকসানের পরিমাণ ঠিক ততটাই হয়। এই লোকসান হওয়ার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও কিন্তু নানান ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।

১। পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক শেয়ার- স্টক মার্কেটে বিনিয়োগকারী লাভ করতে আসে। পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের শেয়ারে লাভ নেই। গত এক মাসে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শেয়ার পড়েছে ২০%। সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক (১৯.৫%), পাঞ্জাব ন্যাশান্যাল ব্যাঙ্ক (১৬.৫%), ওরিএন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স (১৫%) এবং অন্ধ্র ব্যাঙ্কের (১০.৭%) শেয়ারে হয়েছে বড় লোকসান। গত তিন মাসে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র শেয়ারে বিনিয়োগকারী খুইয়েছে ২৪%, ক্যানাড়া ব্যাঙ্কে গেছে ২১%, এবং ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে লোপাট গেছে ২০% টাকা। এক বছরের সময়সীমা দেখলে, খোদ এসবিআই-এর শেয়ার কিনে মানুষ হারিয়েছে ২০%।

যত লোকসান বাড়ছে, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে। আপনাদের মনে রাখতে হবে ব্যাঙ্কের টাকা লোকসান গেলে ঋণ/লোন দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। লোন/ঋণ না দিলে, ব্যাঙ্ক লাভ করতে পারে না। এখন সরকার যদি নিজের ব্যাঙ্কদের বাঁচাতে মোটা টাকা বারবার দিতে থাকে, তবেই এই ব্যাঙ্কগুলোর সমস্যা কমবে।

২। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষতি - পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর একটা বিশেষ গুণ হল তারা মোটা টাকা ডিভিডেন্ড দেয়। হ্যাঁ, সরকারকে টাকা এই ভাবেই ফেরত দিত বেশির ভাগ পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক। ডিভিডেন্ড হল খানিকটা সুদের মতন। একটা স্থায়ী পরিমাণের টাকা প্রত্যেক বছর ডিভিডেন্ড মারফত দিয়ে দেয়। আপনি হয়ত পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের শেয়ার কেনেননি, কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড কিনে থাকতেই পারেন।

আরও পড়ুন়
লোন চাই? জীবন বিমা পলিসি আছে তো? চিন্তা নেই...

এক বছরে ৫০% ক্ষতি হয়েছে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শেয়ারে। এইচডিএফসি মিউচুয়াল ফান্ডের ম্যানেজাররা হয়ত ধরে রেখেছেন এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শেয়ার এই আশায় যে একদিন বাড়বে স্টক। ওরিএন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্সের নানান শেয়ার কিনে রেখেছে রিলায়্যান্স মিউচুয়াল ফান্ডের কিছু স্কিম। আইসিআইসিআই মিউচুয়াল ফান্ড ধরে আছে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের অনেক শেয়ার।

আপনার টাকা যদি এমন স্কিমে থাকে যেখানে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর অনেক শেয়ার আছে, সেই ধাক্কা আপনাকে খেতে একটু হবে বইকি। যদি, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর শেয়ার উপরে যায়, লাভ ভোগ করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে যে অনেক ইনসিওরেন্স প্ল্যান বা ইউলিপের টাকাও হয়ত আছে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর শেয়ারে। শেয়ার বাজারে ক্ষতি হলে, সেই ক্ষতির মাসুল দিতে হবে।

৩। নানাবিধ চার্জ - আমরা আগেই দেখেছি যে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলো কী ভাবে আমানতকারীদের উপর নিত্য নতুন চার্জের বোঝা চাপিয়েছে। ব্যাঙ্কের যেহেতু লোনের ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছে, তাই টাকা উপার্জন করার জন্যে ডেবিট কার্ডের ব্যবহার, চেক, ড্রাফ্‌ট, ক্রেডিট কার্ড এবং অ্যাকাউন্টের উপর বেশি করে চার্জ লাগিয়েছে। এতে আপনাদের সমস্যা বেড়েছে। অনেকেই রেগেমেগে পুরনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছেন।

হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান করে আবার পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলো চার্জ লাগাতে পারে। এটা হবে দ্বিতীয় অধ্যায়। নিজের টাকা নিজেরই অ্যাকাউন্ট থেকে তুলতে হয়ত আটকাবে না, কিন্তু নানান ফন্দি কেটে চার্জ লাগিয়ে দিলে আমি এবং আপনি টাকা বার করার সময় বাধ্য হব ব্যাঙ্ককে কিছু টাকা দিতে।

৪। বন্ড মার্কেট - মনে রাখবেন যে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলো বন্ড বাজারে অনেক টাকা রাখে। বন্ড বাজার শেয়ার বাজারের মতন শীঘ্র ওঠানামা না করলেও, উপর বা নীচে যায় একটু আধটু। যেহেতু লোকসান হচ্ছে, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলো হয়ত বন্ড মার্কেট থেকে টাকা সরিয়ে রাখবে। বা, নতুন বন্ড বাজারে এলে কিনতে পারবে না। কারণ লোন ব্যবসা থেকে টাকা সেভাবে উঠছে না।

পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর এই কার্যকলাপ আপনার বন্ড মার্কেটে যে টাকা রাখা আছে তাঁর উপর প্রভাব ফেলবে। বন্ড মার্কেটে বিশাল লোকসান হয় না, কারণ বন্ড হল একপ্রকার ঋণ। কিন্তু তবুও, বন্ড মার্কেটে থাকে নানান মানুষের কষ্টের টাকা। প্রভিডেন্ট ফান্ড— ই পি এফ, পি পি এফ— নানান সরকারি সংস্থার টাকা, এবং বড় বড় জীবন বিমা কোম্পানি বন্ড বাজারে টাকা খাটায়। এই বাজারের অন্যতম অংশগ্রহণকারী, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক, যদি যদি চুপ মেরে যায়, বিশাল প্রভাব পড়তে পারে।

Economy SBI State Bank Of India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy