Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কর ছাড়ে চাহিদা বাড়বে কি, দানা বাঁধছে সংশয়

সরকার থেকে শিল্পমহল— অনেক দিন ধরে সকলে বলছেন, চাহিদায় ভাটার কারণেই ঝিমিয়ে পড়েছে বৃদ্ধি। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে খাদের মুখে।

নির্মলা সীতারামন।

নির্মলা সীতারামন।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:২৫
Share: Save:

কর্পোরেট কর কমানোয় শিল্পমহল উচ্ছ্বসিত। দেওয়ালির রোশনাই শেয়ার বাজারে। কিন্তু এর হাত ধরে কি সত্যিই গতি ফিরবে চাহিদার চাকায়? চাঙ্গা হবে অর্থনীতি? নাকি কর্পোরেটের মুনাফার ঝাঁপি ফুলেফেঁপে উঠলেও, সেই অনুপাতে তার সুফল পাবেন না দেশের সাধারণ মানুষ? এ নিয়ে সংশয় ক্রমশ দানা বাঁধছে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সাড়া ফেলে দেওয়া ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই।

সরকার থেকে শিল্পমহল— অনেক দিন ধরে সকলে বলছেন, চাহিদায় ভাটার কারণেই ঝিমিয়ে পড়েছে বৃদ্ধি। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে খাদের মুখে। এই অবস্থায় গত কাল লগ্নির ইচ্ছে বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কর্পোরেট কর ছাঁটাই করেছেন সীতারামন। যুক্তি, এতে সংস্থাগুলির নিট আয় বাড়বে। ওই বাড়তি টাকা বিনিয়োগ করবে তারা। লগ্নি বাড়লে, কাঁচামালের চাহিদা বাড়বে। সঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। আবার কল-কারখানায় কাজের সুযোগ এবং মজুরি বাড়লে, লোকের হাতে টাকা আসবে। ফলে বাড়বে কেনাকাটা। সব মিলিয়ে, চাঙ্গা হবে অর্থনীতি।

কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, যদি হাতে টাকা না-থাকার কারণে শিল্প লগ্নি করতে না পারে, তবে হয়তো এই যুক্তি খাটে। কিন্তু যেখানে চাহিদাই বাড়ন্ত, সেখানে কর কমার দরুন হাতে আসা বাড়তি টাকা নতুন করে বিনিয়োগের কথা ভাববে কোন শিল্প? এর থেকে সাধারণ মানুষের হাতে সরাসরি টাকা যাওয়ার মতো সরকারি প্রকল্পে এই অঙ্ক ঢালা হলে, সেই ওষুধ অনেক বেশি কার্যকরী হত বলে মনে করছেন তাঁরা।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটকের অভিযোগ, ‘‘দেশ যখন গভীর মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন কর্পোরেটের জন্য এই কর ছাড় আসলে ধনীদের জন্য পুনর্বণ্টন। অথচ দরিদ্রদের জন্য কোনও প্রকল্পের কথা হলেই কর্পোরেট মুখপাত্ররা প্রথমেই তাকে সমাজতন্ত্র বলে উড়িয়ে দেন!’’ তাঁর মতে, সেনসেক্স

বাড়লে তো চাহিদা বাড়ে না। তাই এর বদলে পরিকাঠামোয় সরকারি ব্যয় বাড়লে যে বাড়তি কাজের সুযোগ তৈরি হত, তা-ও অনেক কাজের হত।

একই মতের শরিক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির অর্থনীতির অধ্যাপক পিনাকী চক্রবর্তী। মৈত্রীশ যেমন প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী কিসান যোজনাতেও বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলছেন, তেমনই পিনাকী বলছেন গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের কথা। তাঁদের মতে, এই ধরনের প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বাড়লে বরং গরিব, সাধারণ মানুষের হাতে কিছুটা টাকা আসত। বাড়ত চাহিদা। আর চাহিদার দেখা মিললে, তবেই তো লগ্নিতে আগ্রহী হবেন শিল্পপতিরা। নইলে কর ছাঁটাইয়ের দরুন সংস্থার নিট আয় বা মুনাফা হয়তো বাড়বে। কিন্তু সেই বাড়তি টাকা ঢালতে কিছুতেই আগ্রহ দেখাবেন না তাঁরা।

বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা পুরো ব্যবহারের পরেও বাড়তি চাহিদা বাজারে থাকলে, তবেই নতুন লগ্নির কথা ভাবে শিল্প। তাই আইআইএম-কলকাতার অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অনুপ সিংহের প্রশ্ন, ‘‘যেখানে চাহিদাই নেই, তার অভাবে মাঝেমধ্যে কিছু দিনের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থাকে, সেখানে এখনই নতুন করে তারা লগ্নির পথে হাঁটবে কেন?’’ তা ছাড়া, গত পাঁচ বছরে কর্পোরেট মুনাফার অঙ্ক বাড়লেও, সেই অনুপাতে বেতন বাড়েনি সেখানে। তাই এখন সংস্থার বাড়তি টাকা বর্ধিত বেতন হিসেবে চুঁইয়ে কতটা কর্মীর পকেটে যাবে, প্রশ্ন থাকছে তা নিয়েও।

শুধু তা-ই নয়। এই কর ছাঁটাইয়ে রাজস্ব আদায় ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা ধাক্কা খাবে বলে ধারণা কেন্দ্রের। অনেকেরই প্রশ্ন, তা সামলাতে আয় বাড়বে কোন খাতে? নাকি আখেরে মাত্রা ছাড়াবে রাজকোষ ঘাটতি? সে ক্ষেত্রে মূল্যায়ন সংস্থাগুলির রেটিং ছাঁটাইয়ের মুখে পড়বে না তো ভারত? তাহলে কিন্তু আরও কঠিন হবে বিদেশি লগ্নি আসা। ধাক্কা খাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মূল লক্ষ্যই।

কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের আবার জিজ্ঞাসা, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘর থেকে ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা না পেলে এত বড় কর ছাড় দেওয়া সম্ভব হত কি? তবে কি ঘুরপথে শীর্ষ ব্যাঙ্কের তহবিলেরই ভাগ পেল শিল্পমহল? যেখানে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর তথা অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন স্পষ্ট বলেছিলেন, শীর্ষ ব্যাঙ্কের তহবিল যেন একমাত্র ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা পোক্ত করা ছাড়া আর অন্য কোনও কাজে ব্যবহার না করে কেন্দ্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Corporate Tax Finance Ministry Nirmala Sitharaman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE