Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Water

‘নিয়ম ভেঙে’ ভূগর্ভস্থ জল তুলে আর্সেনিক মানচিত্রে কলকাতাও

প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়েন বিষ-ব্যূহে। আর সেই বিষের মাত্রা বাড়তে বাড়তে ক্রমেই গ্রাস করে ফেলছে কলকাতা-সহ এ রাজ্যকে!বিষের মাত্রা বাড়তে বাড়তে ক্রমেই গ্রাস করে ফেলছে কলকাতা-সহ এ রাজ্যকে!

ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:০৩
Share: Save:

হাতে কয়েক হাজার টাকা থাকলেই হল। তার পরে পাইপ পুঁতে পাম্পের মাধ্যমে জল তুলে নেওয়া। আইনের ফাঁক গলে এ ভাবেই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পাম্প আর্সেনিকের বিপদ বাড়িয়ে চলেছে। সরকারি নথিভুক্ত পাম্পের তুলনায় যে পাম্পের সংখ্যা কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে পাঁচ-ছ’গুণ বেশি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু বেশি হলে কী হবে, গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জল তোলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইন থাকলেও ছোট নলকূপের জন্য তেমন কোনও আইন নেই। যার ফলে কলকাতারই একাধিক অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতায় ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে।

ওই এলাকার ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটরদের বক্তব্য, এমনিতেই দক্ষিণ কলকাতায় পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে। কারণ, জল সরবরাহের সেই পরিকাঠামোই এখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি দক্ষিণে। ‘ক্যাপসুল’ বুস্টার পাম্পিং স্টেশন করে, পাইপলাইনের মাধ্যমে পুরসভা পরিস্রুত জল সরবরাহের চেষ্টা করলেও তার পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। ফলে বহু বাসিন্দাই ছোট নলকূপ বসিয়ে মাটি থেকে জল তুলছেন।

‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্‌থ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা, অধ্যাপক অরুণাভ মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘ছোট নলকূপ বসানো আটকানোর জন্য আইনে সংস্থান নেই। ফলে অনেকেই মাত্র কয়েক হাজার টাকা খরচে জল তুলে নিচ্ছেন।’’ বেআইনি ভাবে পাম্পের মাধ্যমে জল তোলার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল বছর পাঁচেক আগে। বিষয়টি নিয়ে মামলা হওয়ায় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুর কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কড়া শাস্তি, যেমন জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টিতে তেমন নজরদারি নেই বলে জানাচ্ছেন পুর কর্তাদের একাংশ। অনেক ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটরের আবার বক্তব্য, জল সরবরাহের ঘাটতি মেটাতে পুরসভা তো নিজেই অনেক সময় নলকূপ বসাচ্ছে! ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘গভীর নলকূপের উপরে নির্ভরতা কমানোর পরিবর্তে জলের ঘাটতি মেটাতে পুরসভাই এই পন্থা নিয়েছে। যা আর্সেনিকের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে।’’

বিপদ যেখানে

শহরের আর্সেনিক চিত্র

• কলকাতা পুর এলাকায় মোট ১৪৪টি ওয়ার্ড

• ভূগর্ভস্থ জলে নির্ধারিত মাত্রার (প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম) বেশি আর্সেনিক মিলেছে তার ৭৭টি ওয়ার্ডে

• ৭৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক মিলেছে ৩৭টি ওয়ার্ডে

• ৩৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯টি ওয়ার্ডই দক্ষিণ কলকাতার

• ওই ১৯টি ওয়ার্ড হল ৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৩, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮, ১০২, ১০৩, ১০৪, ১১০, ১১১, ১১২, ১১৩, ১১৮, ১২০, ১২১, ১২৩

• সর্বাধিক আর্সেনিক মিলেছে ০.৮২ মিলিগ্রাম (নির্ধারিত মাত্রার ৮২ গুণ বেশি!)

• নির্ধারিত মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে ৬৪টি ওয়ার্ডে

• সমীক্ষা হয়নি-৩টি ওয়ার্ডে

সূত্র: (স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)

শহরের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের আশঙ্কা যে বাড়ছে, তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’-এর সমীক্ষাই বলছে। সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতার ৭৭টি ওয়ার্ডের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার (প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম) থেকে বেশি। ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল

স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক-গবেষক তড়িৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এত দিন কলকাতাকে আর্সেনিকের বিষ-বৃত্তের বাইরে বলে মনে করা হত। কিন্তু এখন একাধিক ওয়ার্ডে, বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতায় ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি মিলেছে।’’

কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ তথ্য মানতে চাননি। জল সরবরাহ দফতরের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘নিয়মিত আর্সেনিকের মাত্রা পরীক্ষা হয়। তেমন কিছু মেলেনি।’’ দক্ষিণের ১০ নম্বর বরোর কোঅর্ডিনেটর তপন দাশগুপ্তেরও দাবি, ‘‘আমাদের বরোয় আর্সেনিক আছে বলে শুনিনি।’’ যার পরিপ্রেক্ষিতে এক গবেষকের কথায়, ‘‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ হওয়া পরিস্রুত জলে আর্সেনিক রয়েছে, এমন কথা তো বলা হয়নি। নমুনা পরীক্ষার পরেই ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি বলা হয়েছে।’’

রাজ্য আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের সদস্য দেবেন্দ্রনাথ গুহ মজুমদার জানাচ্ছেন, সম্প্রতি নদিয়ার একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, আর্সেনিক রোগীদের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৫-’০৬ সালে প্রায় ১০ হাজার আর্সেনিক আক্রান্তকে নিয়ে সমীক্ষা করেছিলাম। তাঁদের প্রায় আট হাজার আক্রান্তকে ২০১৭-’২০ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, সাধারণ মানুষের তুলনায় আর্সেনিকপ্রবণ এলাকার মানুষের ক্যানসারে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।’’

আর্সেনিক-দূষণের নিরিখে কলকাতা এখনও নদিয়া বা রাজ্যের অন্য আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলের মতো হয়নি ঠিকই। কিন্তু নলকূপ বসানো বন্ধ না হলে শহরের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের মাত্রা ও আর্সেনিকপ্রবণ এলাকার পরিধি ক্রমেই বাড়বে, সে ব্যাপারে এখনই সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Water Health Arsenic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE