Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দুই গুপ্তচরের সান্ধ্য আড্ডা

কানাঘুষো গপ্পো অনেক হয়েছিল। এ বার পাকিস্তানের প্রাক্তন আইএসআই প্রধান জেনারেল আসাদ দুরানি এই আমেরিকা-পাকিস্তান আগাম ‘ডিল’-এর কথাটাই দিয়েছেন ফাঁস করে। আর কার সামনে এই স্বীকারোক্তি? তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রাক্তন সচিব এ এস দুলাত। এক গুপ্তচর যদি আর এক গুপ্তচরকে সব কথা জানিয়ে দেন, এ তো সামান্য ব্যাপার নয়!

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৮ ০০:৩২
Share: Save:

দ্য স্পাই ক্রনিকল্‌স/ র, আইএসআই অ্যান্ড দি ইলিউশন অব পিস

এ এস দুলাত, আসাদ দুরানি, আদিত্য সিন্‌হা

৭৯৯.০০

হার্পার কলিন্স

ইসকো লে জাও। লে জাও। টেক হিম। উই আর গোয়িং টু ফেন ইগনোরেন্স।

— এক গোপন বৈঠকে এই কথাটাই বললেন পাক গোয়েন্দা কর্তা। বললেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র এক বড়কর্তাকে। কিন্তু কাকে দেওয়ার কথা হয়েছিল সে দিন?

লোকটির নাম ওসামা বিন লাদেন।

কানাঘুষো গপ্পো অনেক হয়েছিল। এ বার পাকিস্তানের প্রাক্তন আইএসআই প্রধান জেনারেল আসাদ দুরানি এই আমেরিকা-পাকিস্তান আগাম ‘ডিল’-এর কথাটাই দিয়েছেন ফাঁস করে। আর কার সামনে এই স্বীকারোক্তি? তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রাক্তন সচিব এ এস দুলাত। এক গুপ্তচর যদি আর এক গুপ্তচরকে সব কথা জানিয়ে দেন, এ তো সামান্য ব্যাপার নয়!

সম্প্রতি দুই প্রাক্তন গোয়েন্দা, দুলাত আর দুরানি, নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাংবাদিক আদিত্য সিন্‌হা সেই কথোপকথন পরিচালনা করেছেন। এই আড্ডা থেকে জন্ম নিয়েছে আলোচ্য বইটি। ভারত ও পাকিস্তানের দুই স্পাইমাস্টার যৌথ ভাবে এ বই লেখেননি। আদিত্য সিন্‌হার সঙ্গে তাঁদের কথোপকথনের নথিভুক্ত দলিল এটি।

দুরানি জানিয়েছেন, আমেরিকা ওসামাকে হত্যা করার কয়েক দিন আগেই পাক সেনাপ্রধান কায়ানি এক এয়ার বেস-এ গোপন বৈঠক করেন মার্কিন সেনা কমান্ডার ডেভিড পেট্রাউস-এর সঙ্গে। সালটা ছিল ২০১১।

পাকিস্তান আমেরিকাকে বলে, বিন লাদেনকে ধরে দিতে সব রকম সাহায্য আমরা করব, কিন্তু দুনিয়ার সামনে জানাব না আমরা জানতাম, কারণ তাতে পাকিস্তানের ভিতরে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে। বিন লাদেনের প্রতি পাকিস্তানের বহু মানুষ তখনও শ্রদ্ধাশীল, আজও। দুরানির এই কথা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানে আগুন জ্বলে ওঠে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ দুরানি পাক গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন। এখন পাক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পর্যন্ত নেই তাঁর। কারণ, পাকিস্তানের গোয়েন্দারা আর সেনাবাহিনী কাশ্মীরে কী করছে, ভারতের নানা প্রান্তে কী ভাবে সন্ত্রাস ছাড়াচ্ছে, সবই তিনি বলে দিয়েছেন।

বিন লাদেন কোথায় আছে সে খবরও নাকি দুরানি জানতেন। তিনি আমেরিকাকে বলেছিলেন, সীমান্তে গোপন গুহা বানিয়ে কোনও নির্জন প্রান্তে বিন লাদেন আছে বলে মনে হয় না, সে আছে পাকিস্তানের জনবহুল কোনও বস্তি এলাকায়।

এখন অবশ্য দুরানি বলছেন, আমি যা বলেছি সে আমার অনুমান, আমার বিশ্লেষণ, কোনও ভাবেই তা ‘তথ্য’ ছিল না।

বিন লাদেন কোথায় আছে তা খুঁজে বের করতে আমেরিকা এক ডাক্তারকে পাকিস্তানে পাঠায়। তিনি এক এনজিও-র তরফে গরিব ঘিঞ্জি এলাকাগুলোতে গিয়ে পোলিয়োর প্রতিষেধক বিতরণ করতেন। কিন্তু আসলে সেটা ছিল ফেক এনজিও। ডাক্তার আফ্রিদি ছিল তাঁর নাম। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন, জানতে চাইতেন বাড়িতে কোনও শিশু আছে কি না। এ ভাবেই সিআইএ ওই ভুয়ো ডাক্তারকে দিয়ে বিন লাদেনকে খুঁজে বার করে। দুলাত দুরানিকে বলেন, আমেরিকা তো পাক গোয়েন্দাদের মধ্যেও তাদের নিজেদের ‘মোল’ রেখে দিয়েছিল। দুরানি জানাচ্ছেন, এক অবসরপ্রাপ্ত পাক অফিসার আমেরিকার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আইএসআই-এর পাওয়া খবর পাচার করত। ৫০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল লোকটা।

তুলনায় দুলাত ভারতীয় গোয়েন্দাদের গোপন কথা শুনিয়েছেন কম। অবশ্য বলেছেন, কী ভাবে তিনি পারভেজ মুশারফকে সাংঘাতিক এক গোপন তথ্য দিয়ে প্রাণে বাঁচান। গোয়েন্দা সূত্রে খবর ছিল, জইশ-এ-মহম্মদ-এর জঙ্গিরা পারভেজকে হত্যা করার চক্রান্ত করেছে। পারভেজকে সে খবর জানিয়ে দেয় ভারত। কিন্তু দুরানিকে দুলাত জানিয়েছেন, মুম্বইয়ের ২৬/১১ সন্ত্রাসের পিছনে ছিলেন পারভেজ। পারভেজ তখন ক্ষমতায় নেই, তবু এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন।

আপাতত বইটিকে নিয়ে অন্য এক বিতর্ক শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরই এক শীর্ষ অফিসার সে দিন হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা বলুন তো, এই বইটি স্টেট অ্যাক্টর না কি নন স্টেট অ্যাক্টর? অর্থাৎ, এই বইটি করার পিছনে রাষ্ট্র, মানে সরকার নেই তো?’’

পাকিস্তান কী ভাবে ভারতে সন্ত্রাস করছে, তার স্বীকারোক্তি যদি কোনও পাক অফিসার করেন তবে তাতে বিজেপির পুলকিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ তো আছেই! আরও অবাক হই যখন দেখি দুরানি বলছেন যে তিনি মনে করেন, ২০১৯ সালে মোদী আবার জিতে প্রধানমন্ত্রী হবেন। দুলাতও বলছেন বিজেপি থাকলে পাকিস্তান সমস্যা সমাধান সহজতর।

আমার তো মনে হয় এ ধরনের বই— যেখানে পাকিস্তান স্বীকার করছে যে তারা ভারতে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে— প্রকাশিত হলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করা সহজ হয় কিন্তু তাতে দু’দেশের শান্তি প্রক্রিয়া কি বাধাপ্রাপ্ত হয় না? কাশ্মীর সমস্যা থেকে সংসদ আক্রমণ, অমৃতসরে বিমান ছিনতাই থেকে কার্গিলের সংঘর্ষ— আলোচনা অনেক হল। শঙ্কা, এ বার যদি আরও বড় রকমের সন্ত্রাস ঘটায় পাক জঙ্গিরা? তখন কি লোকদেখানো সার্জিকাল স্ট্রাইক করলে হবে? তখন ভারতীয় সেনাকে পাক সীমান্ত পার হয়ে আক্রমণ হানতে হবে না তো?

২০০৫-এ তৎকালীন বিরোধী নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। পারভেজ তখন দেশের প্রেসিডেন্ট। রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁর সেনাপ্রধানের বাড়িতেই থাকতেন। পারভেজ সে বাড়িতেই আডবাণীকে আমন্ত্রণ জানান। বৈঠকে আডবাণীর সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার শিবশঙ্কর মেনন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে আডবাণী খুব খুশি। তিনি বললেন, জানো আজ প্রথম পারভেজ স্বীকার করল যে জঙ্গি শিবিরগুলোকে পাকিস্তান ট্রেনিং দেয় কাশ্মীরে। শুধু তাই নয় ধীরে ধীরে এই শিবিরগুলো পাকিস্তান নির্মূল করে দেবে বলে কথা দিয়েছে!

আমি বললাম এটা আজই লিখতে হবে। এ তো আন্তর্জাতিক স্কুপ। তখন মেনন বললেন, লিখলে পারভেজ পাকিস্তানে বিপদে পড়বে। কিছু করতে চাইলেও আর করতে পারবে না মৌলবাদীদের চাপে। আডবাণী বললেন, বিজেপির নির্বাচনী রাজনীতির জন্য এ প্রচার ভাল কিন্তু মেনন ঠিক বলছেন— দেশের জন্য ভাল হবে না।

সেই ঐতিহ্য যদি মানতে হয়— তা হলে বোধহয় এই বইটি ভারত-পাকিস্তান শান্তি প্রক্রিয়ার অন্তরায় হবে। গোপনীয়তা আজও কূটনীতির ব্রহ্মাস্ত্র।

বইটিতে বহু প্রশ্নই করা হয়নি। বহু প্রশ্নের জবাবও দেননি দু’পক্ষই। বহু প্রশ্নের জবাব আবার নামমাত্র। ২০০১ সালে সংসদ আক্রমণ কে করল? দুরানি কোনও জবাব দেননি। ২৬/১১ মুম্বই আক্রমণের পিছনে কে? দুরানি জানেন না। কার্গিল সম্পর্কে দুরানির বক্তব্য: বোকার মতো কাজ। হাফিজ সইদ— রাজনীতির ‘কস্ট’ বেশি হয়ে গেল। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

তা হলে? দুই অবসরপ্রাপ্ত গুপ্তচরের সান্ধ্য আড্ডায় তাঁদের অহংবোধের তৃপ্তি ছাড়া আর কি কিছু করতে পারল এ বই? পরবর্তী গুপ্তচর-গোয়েন্দা অফিসারদের জন্যও কি দিশা রাখতে পারল?

এবং সর্বশেষ প্রশ্ন: এ ধরনের একটি বইয়ের উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্নও আদিত্য করেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE