জেলখানার মহিলা ওয়র্ড— ভেবে দেখলে, এর চেয়ে বিচিত্র জায়গার সন্ধান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পাওয়া দুষ্কর। জেল হল রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ান্ততম প্রতীক। এমন একটা পরিসর, যেখানে কাউকে বন্দি করার অর্থ, রাষ্ট্র তার অপরাধের— অথবা, রাষ্ট্র যাকে ‘অপরাধ’ বলে মনে করে, অথবা যে কল্পিত ‘অপরাধ’-এর দায় চাপাতে চায় কারও ঘাড়ে— শাস্তি হিসাবে কেড়ে নিচ্ছে তার যাবতীয় নাগরিক স্বাধীনতা, এমনকি জীবনের মৌলিক অধিকারেরও অংশবিশেষ। জেলে বন্দি থাকা মানে স্ব-ক্ষমতাহীন একটি অস্তিত্ব। আর, ভারতের মতো দেশে তো মেয়েরা এমনিতেই ক্ষমতার সিঁড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। জেলখানার পরিসর তাই ক্ষমতার উচ্চাবচ সিঁড়ির দুই প্রান্তের দু’টি অস্তিত্বকে দাঁড় করিয়ে দেয় মুখোমুখি। সুধা ভরদ্বাজকে অবশ্য ‘ক্ষমতাহীন নারী’র খাঁচায় বন্দি করে দেখা যাবে না কোনও মতেই। নিজের উচ্চশিক্ষা, সামাজিক প্রভাবের গণ্ডি ছাপিয়ে গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে তিনি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন পিছিয়ে থাকা মানুষের ভরসা হয়ে ওঠার জীবন। মধ্যপ্রদেশে শঙ্কর গুহনিয়োগীর আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করার অভ্যাস তাঁকে ক্ষমতার অপ্রীতিভাজন করেছে। ভীমা কোরেগাঁও নামক এক অলীক মামলার অপরাধী হিসাবে তিনি তিন বছর জেলে কাটালেন— প্রথমে পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে, তার পর মুম্বইয়ের বাইকুল্লা জেলে। ২০১৮-র নভেম্বর থেকে ২০২০-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইয়েরওয়াড়া জেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ফ্রম ফাঁসি ইয়ার্ড: মাই ইয়ার উইদ উইমেন অব ইয়েরওয়াড়া (২০২৩)। বইটির বঙ্গানুবাদ করে সোমনাথ গুহ পাঠকের কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন।
ফাঁসি ইয়ার্ড থেকে: ইয়েরওয়াড়ার মহিলাদের সঙ্গে আমার একটি বছর
সুধা ভরদ্বাজ
(ভাষান্তর: সোমনাথ গুহ)
৪০০.০০
সারস

সেই জেলের বন্দিনিদের সঙ্গে সুধা এবং তাঁর সহ-বিচারাধীন বন্দি অধ্যাপক সোমা সেনের কথা বলা বারণ ছিল কঠোর ভাবে। তবু তাঁদের গল্প পৌঁছেছিল সুধার কাছে, বিভিন্ন পথ ধরে। কখনও আদালতে যাওয়ার পথে পুলিশ ভ্যানে, কখনও জেলের দাওয়াখানার সামনে অপেক্ষারত অবস্থায়; আবার কখনও দেওয়াল টপকে কানে আসত তাঁদের পারস্পরিক ঝগড়া, অকথ্য গালিগালাজের মধ্যে গেঁথে থাকা জীবনের টুকরোটাকরা কথা। সুধা তাঁর সেলে বসে জেল থেকেই কেনা নোটবুকে টুকে রাখতেন সেই সব মেয়ের কথা। কোনও তত্ত্ব ছাড়া, এমনকি বিশেষ সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণেরও তোয়াক্কা না করে সেই কথাগুলি দিয়েই তৈরি হয়েছে এই বই।
যেমন রয়েছে এক ষাটোর্ধ্ব মহিলার কথা, অভিজাত-দর্শন, বই পড়তে, সেলাই করতে ভালবাসেন। জানিয়েছিলেন, কোনও এক কালে এক দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি। স্বামী-হত্যার অপরাধে জেল খাটছেন। আবার আছে এক মহিলার কথা, যাঁর বাহ্যিক রূপ আহামরি নয় কোনও মতেই, কিন্তু তিনি সমানেই প্রশ্ন করেন যে, তাঁকে খবরের কাগজে ছবি বেরোনো মডেলদের মতোই দেখতে কি না। প্রশ্নটি তাঁর মানসিক বৈকল্যের ফল, না কি এক প্রকাণ্ড ইয়ার্কি, সুধা সেই প্রশ্নটির উত্তর পাননি। দেখা পেয়েছেন প্রেমিকের কাছে ঠকে যাওয়া মেয়ের, স্বামীর অপরাধে ফেঁসে যাওয়া জেলবন্দি নারীর, আবার দেখেছেন ঘোর অপরাধপ্রবণ মেয়েদেরও। দেখেছেন, কী ভাবে জেলের মধ্যে সামান্যতম সুবিধার সিংহভাগ দখলের জন্য অন্যদের পিছনে ফেলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে নিরন্তর। এবং দেখেছেন সেই সব শিশুকে, মা কারাবন্দি বলে যাদের শৈশব কেটে যায় জেলের চার দেওয়ালের মধ্যেই। তবে, এই বন্দিত্বও যে কোনও কোনও মেয়ের কাছে নিরাপদতর আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে, সে কথাটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবতে হয়, কী এক আশ্চর্য দুনিয়াই না গড়ে রেখেছে এই রাষ্ট্রযন্ত্র— কী জেলখানার ভিতরে, কী বাইরে।
দ্য পারপাস অব লাইফ: ফাইন্ড ইয়োর পাথ টু ওয়াননেস
হারিৎ রত্ন
২৯৯.০০
ফিঙ্গারপ্রিন্ট

প্রতি দিনের চব্বিশ ঘণ্টার অজস্র মুহূর্তের কতগুলিকে আমরা সচেতন ভাবে খেয়াল করি? ঠিক ক’টি মুহূর্তে আমরা স্বজ্ঞাতে বাঁচি? প্রকৃত অর্থে জাগ্রত থাকি? এই প্রশ্নের সমানে দাঁড়ালে বোঝা যায়, আসলে আমরা হয় অতীতে বাঁচি, নয় ভবিষ্যতে— হয় অতীতের ভুল অথবা গৌরব আমাদের মগজের পরিসরটুকু দখল করে রাখে, নয় ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা। হারিৎ রত্ন বর্তমান মুহূর্তটিতে সচেতন ভাবে বেঁচে থাকার পথের সন্ধান করেছেন। তা শুধু সেই মুহূর্তটির প্রতি, সেই মুহূর্তের পারিপার্শ্বিকের প্রতি মনোযোগে সীমাবদ্ধ নয়— মুহূর্তের প্রতি সচেতনতা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে, দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য এই মুহূর্তে কোন কাজটি করা অথবা না-করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিখিল বিশ্বের সঙ্গে ‘একাত্ম’ হওয়ার, ‘অদ্বৈত’ হওয়ার আর কোনও পথ আছে কি? ইতিহাস থেকে পপ-সংস্কৃতি বা বিজ্ঞান— এক বিপুল ক্যানভাসে এই অদ্বৈত-র সন্ধান করেছেন লেখক হারিৎ রত্ন। মূল সুরটি সেই ভগবদ্গীতাতেই: ফলের প্রত্যাশা না করে কাজ করে যাওয়া। প্রশ্নোত্তরের সহজ ভঙ্গিতে লেখা বইটি পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছবে। গভীর কথা বলার জন্য যে কঠিন, দুরধিগম্য ভাষা আবশ্যক নয়, এই বইটি তার হাতেগরম প্রমাণ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)