Advertisement
E-Paper

Bijan Goshal: রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনামগুলির পিছনে যে কারণ ছিল

বিজন ঘোষাল তাঁর বইতে তথ্য-কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তথ্য থেকে তার সম্ভাব্য তাৎপর্যে তিনি যেতে  চাননি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ০৭:২৬
Share
Save

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম কী জিজ্ঞাসা করা হলে সম্ভবত শতকরা সাড়ে নিরানব্বই জন বাঙালি বলবেন— ভানুসিংহ ঠাকুর। ‘ভানুসিংহ’ ভণিতা নিয়ে কবি কিঞ্চিৎ হেঁয়ালি করে থাকলেও ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ স্বনামেই বহাল রয়েছেন। অন্য দিকে, কিশোরী রাণুকে লেখা চিঠিপত্রে পত্রপ্রেরক হিসেবে সম্বন্ধবাচক ‘ভানুদাদা’র উল্লেখ আছে। কিন্তু ভানুসিংহের পত্রাবলী-তে লেখক হিসেবে রয়েছে রবীন্দ্রনাথেরই নাম। যদি এই সব গ্রন্থে বরাবর তিনি স্বনামেই বিরাজ করে থাকেন, তা হলে কি ‘ভানুসিংহ’ বা ‘ভানুদাদা’-কে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম? বলা যায় না বলেই সঙ্গত কারণে তাঁর সঙ্কলিত ও সম্পাদিত ছদ্মনামে রবীন্দ্র-রচনা বইতে বিজন ঘোষাল পূর্বোক্ত বইগুলির কোনও রচনাই সঙ্কলন করেননি।

কিন্তু এর বাইরে এমন অনেক রচনা তিনি সঙ্কলন-সংযোজন করেছেন, যেগুলি রবীন্দ্রনাথের ‘ছদ্মনাম’-এ রচিত বলা উচিত কি না, সেই বিতর্ক উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক, সাময়িকপত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা হিসেবে যে ‘অভিলাষ’-কে শনাক্ত করে সজনীকান্ত দাস একদা সাড়া ফেলেছিলেন, সেই কবিতাটি প্রথম প্রকাশের সময় যদি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা কবিনামের বদলে লেখে ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত’, তা হলে তাকে আলোচ্য বইতে কী ভাবে ‘সংযোজন’ করা যায়? বস্তুত এটি নামই নয়, একটি বিবৃতিমাত্র। দ্বিতীয়ত, সেই বিবৃতির বয়ান পত্রিকা-পক্ষের প্রদত্ত ধরে নেওয়াই সমীচীন।

সে সময়ের সাময়িকপত্রে এ জাতীয় নামের আড়ালের অনেক সাক্ষ্য আছে। পত্রিকাপাঠে নামের আড়াল গ্রন্থপাঠে অনাড়াল হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত তো আছেই। ভারতী পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথের ‘দুদিন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল দিকশূন্য ভট্টাচার্য ছদ্মনামে। অথচ কবিতাটি যখন সন্ধ্যাসংগীত কাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন সেই কবিতার কবিনামের ঘোমটাও যায় ঘুচে! রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনামের আলোচনায় এই রকম অনেকপ্রস্ত জটিলতা আছে।

রবীন্দ্র-গবেষক বিজন ঘোষাল সে ব্যাপারে যে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তা বইটির ‘প্রাসঙ্গিক তথ্য’ ও ভূমিকা পড়লেই বোঝা যায়। তবু, কবির স্বনামের আড়ালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত রচনা দু’মলাটের মধ্যে সঙ্কলন করতে প্রয়াসী হয়েছেন তিনি। কিন্তু কবির আপন নামের আড়ালে প্রকাশিত লেখা মানেই যে তাকে ছদ্মনামে লেখা বলা যায় না, ‘অভিলাষ’ কবিতার উদাহরণেই তা স্পষ্ট। আর তা যদি বলা না-ই যায়, তা হলে আলোচ্য বইটির শিরোনামের প্রতি কিছুটা বা অবিচারই হয়।

ছদ্মনামে রবীন্দ্র-রচনা

সঙ্কলন ও সম্পাদনা: বিজন ঘোষাল

৪০০.০০

লালমাটি

লেখালিখির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আপন নামের যে সব আড়াল ব্যবহার করেছিলেন, তার কতকগুলি প্যাটার্ন আছে। নাতবৌ অমিতা ঠাকুরকে ছয়টি চিঠিতে প্রেরক হিসেবে বিক্রমজিৎ বা বিক্রম মহারাজ নামোল্লেখের কারণ হল, সে সময় তপতী নাটকে কবি স্বয়ং বিক্রমজিতের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, আর তাঁর মহিষীর ভূমিকায় ছিলেন অমিতা ঠাকুর। এর মধ্যে রয়েছে পত্রপ্রাপক-পত্রপ্রেরকের সম্পর্কের সরসতা। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা একটি চিঠিতে প্রেরকের জায়গায় ‘অধিষ্ঠাতা আচার্য’-র উল্লেখ কেন, তাও চিঠির বিষয়বস্তুর দিকে নজর করলেই বোঝা যায়। ওই চিঠির বিষয় শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী। চিঠিটির কৌতুকময় স্বরভঙ্গির সঙ্গে প্রেরকের জায়গায় ‘অধিষ্ঠাতা আচার্য’-র উল্লেখ বেশ মানানসইও। কখনও নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করার জন্য, কখনও অন্য কারণে ‘নামী’ আড়াল টানছেন ‘নাম’-এর উপর; এমন দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথে দুর্লভ নয়। এই নাম-নামীর আড়ালখেলা কখনও সহজবোধ্য, কখনও তার মধ্যে তাত্ত্বিকেরা হয়তো কবির সত্তান্তরের অন্যতর গূঢ় রহস্য খুঁজে পাবেন। ‘নারীর কর্তব্য’ কবিতায় যে ঠাট্টার সুর, তা নারীর স্বরে ব্যক্ত হওয়া সুসঙ্গত বলেই কি ওই কবিতার কবির ছদ্মনাম ‘আন্নাকালী পাকড়াশি’ নয়? উনিশ বছর বয়সে দিকশূন্য ভট্টাচার্য ছদ্মনামে লেখা ‘দুদিন’ কবিতাটির স্বরভঙ্গির সঙ্গেও হয়তো এক ভাবে মিলিয়ে নেওয়া যায় সন্ধ্যাসংগীত পর্বে কবির ‘দিকশূন্য’ মনোভঙ্গির। ‘বিজন চিন্তা’ লেখাটির অন্ত্যভাগে ‘বিধবা’ শব্দটির উল্লেখের কারণ, বিধবার জবানিতেই লেখা হচ্ছে ওই নিবন্ধটি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বনামে প্রকাশিত পত্রাঙ্গিকে লেখা চিঠি-পত্র পুস্তিকাটির ষষ্টিচরণ ও নবীনকিশোর চরিত্র দু’টিকে ছদ্মনামের নামাবলিতে কোনও দিক থেকেই অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়। এই চিঠিগুলি উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক বলেই সেগুলো পরস্পর পরিপূরক; এবং বর্ণানুক্রমে তাদের স্থানবিন্যাসও অকারণ।

বাণীবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনামই। রবীন্দ্রনাথ টেগোর: পোয়েট অ্যান্ড ড্রামাটিস্ট বইয়ের রচয়িতা টমসন সাহেবকে মুখের মতো জবাব দেওয়ার সময় সৌজন্যবশত এই ছদ্মনামের আড়ালটুকু রবীন্দ্রনাথকে নিতেই হয়েছিল। কিন্তু কবির অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর ছদ্মনাম তিনি ছাড়া অন্য কেউও ব্যবহার করতে পারেন কি না, সে বিষয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। অস্বাক্ষরিত রবীন্দ্র-রচনা সঙ্কলনে এই একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। এ ব্যাপারে সজনীকান্তের তৎপরতা, প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ‘রবীন্দ্র-পরিচয়’ শিরোনামের ধারাবাহিক তথ্যপুঞ্জ এবং ছদ্মনামের আড়াল থেকে রবীন্দ্র-রচনাগুলির শনাক্তকরণের একাধিক প্রাজ্ঞপ্রয়াস সত্ত্বেও ‘কে রবীন্দ্র কে অ-রবীন্দ্র’— এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর আজও অনেকাংশে অমীমাংসিত।

বিজন ঘোষাল তাঁর বইতে তথ্য-কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তথ্য থেকে তার সম্ভাব্য তাৎপর্যে তিনি যেতে চাননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল কবির স্বনামের আড়ালে প্রাপ্ত রবীন্দ্র-রচনার প্রদর্শনী। সেখানে তিনি সফল।

Rabindranath Tagore 22 Srabon book review

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।