রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম কী জিজ্ঞাসা করা হলে সম্ভবত শতকরা সাড়ে নিরানব্বই জন বাঙালি বলবেন— ভানুসিংহ ঠাকুর। ‘ভানুসিংহ’ ভণিতা নিয়ে কবি কিঞ্চিৎ হেঁয়ালি করে থাকলেও ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ স্বনামেই বহাল রয়েছেন। অন্য দিকে, কিশোরী রাণুকে লেখা চিঠিপত্রে পত্রপ্রেরক হিসেবে সম্বন্ধবাচক ‘ভানুদাদা’র উল্লেখ আছে। কিন্তু ভানুসিংহের পত্রাবলী-তে লেখক হিসেবে রয়েছে রবীন্দ্রনাথেরই নাম। যদি এই সব গ্রন্থে বরাবর তিনি স্বনামেই বিরাজ করে থাকেন, তা হলে কি ‘ভানুসিংহ’ বা ‘ভানুদাদা’-কে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম? বলা যায় না বলেই সঙ্গত কারণে তাঁর সঙ্কলিত ও সম্পাদিত ছদ্মনামে রবীন্দ্র-রচনা বইতে বিজন ঘোষাল পূর্বোক্ত বইগুলির কোনও রচনাই সঙ্কলন করেননি।
কিন্তু এর বাইরে এমন অনেক রচনা তিনি সঙ্কলন-সংযোজন করেছেন, যেগুলি রবীন্দ্রনাথের ‘ছদ্মনাম’-এ রচিত বলা উচিত কি না, সেই বিতর্ক উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক, সাময়িকপত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা হিসেবে যে ‘অভিলাষ’-কে শনাক্ত করে সজনীকান্ত দাস একদা সাড়া ফেলেছিলেন, সেই কবিতাটি প্রথম প্রকাশের সময় যদি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা কবিনামের বদলে লেখে ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত’, তা হলে তাকে আলোচ্য বইতে কী ভাবে ‘সংযোজন’ করা যায়? বস্তুত এটি নামই নয়, একটি বিবৃতিমাত্র। দ্বিতীয়ত, সেই বিবৃতির বয়ান পত্রিকা-পক্ষের প্রদত্ত ধরে নেওয়াই সমীচীন।
সে সময়ের সাময়িকপত্রে এ জাতীয় নামের আড়ালের অনেক সাক্ষ্য আছে। পত্রিকাপাঠে নামের আড়াল গ্রন্থপাঠে অনাড়াল হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত তো আছেই। ভারতী পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথের ‘দুদিন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল দিকশূন্য ভট্টাচার্য ছদ্মনামে। অথচ কবিতাটি যখন সন্ধ্যাসংগীত কাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন সেই কবিতার কবিনামের ঘোমটাও যায় ঘুচে! রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনামের আলোচনায় এই রকম অনেকপ্রস্ত জটিলতা আছে।