Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
book review

‘বলার স্বাধীনতা, জানার স্বাধীনতা’

বই জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে এক রেনেসাঁ-মানুষের শীলিত ও শানিত স্বর, যিনি সহিষ্ণুতা ও ন্যায়পরায়ণতার বোধে সমুজ্জ্বল, অন্যায় ও অসঙ্গতির প্রতিবাদে নির্দ্বিধ।

পিয়াস মজিদ
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২১ ০৫:০৯
Share: Save:

মহামানবের সাগরতীরে
আনিসুজ্জামান
৩২০.০০ (বাংলাদেশি টাকা)
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

গবেষক-অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রয়াণের পর তাঁর ৮৪তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে প্রকাশিত হয় বিচিত্র বিষয়ে তাঁর রচনার নির্বাচিত সঙ্কলন মহামানবের সাগরতীরে। ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও স্মৃতি— এই চার ভাগে ২৬টি ছোট-বড় রচনা রয়েছে বইটির পরিসরে। সূচনা আনিসুজ্জামানের জীবনের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় ভাষা আন্দোলন দিয়ে, আর সমাপন ঘটেছে ২০১৭ সালে তাঁর ৮০ বছরের জন্মদিনে প্রদত্ত অভিভাষণের মধ্য দিয়ে। বই জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে এক রেনেসাঁ-মানুষের শীলিত ও শানিত স্বর, যিনি সহিষ্ণুতা ও ন্যায়পরায়ণতার বোধে সমুজ্জ্বল, অন্যায় ও অসঙ্গতির প্রতিবাদে নির্দ্বিধ।

একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে লেখা ‘পঞ্চাশ বছরের অবিরাম স্বপ্ন’-এ আনিসুজ্জামান আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেন বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে, ভাষার জন্য রক্তদানের মর্ম আজ যারা প্রায়-বিস্মৃত। তিনি বলছেন: “বাংলাও যে ভালো করে শিখছি, তা বলার উপায় নেই। তারও নানা কারণ। একটা বড় কারণ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান এখন উঠেই যাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, উপভাষার প্রতি আকর্ষণ। তৃতীয় কারণ, বইপত্রে ভুল পড়ে বেড়ে ওঠা। পাঠ্যবই থেকে সংবাদপত্র পর্যন্ত বানানের অশুদ্ধি, শব্দপ্রয়োগের অশুদ্ধি, বাক্যগঠনের অশুদ্ধি। কখনো এর জন্য দায়ী আমাদের অজ্ঞতা কখনো আলস্য। অভিধান দেখার আলস্য, ‘তাঁর’ লিখতে চন্দ্রবিন্দু দিতে আলস্য। আবার ইংরেজি নিয়মে অ্যাপোসট্রফি লাগিয়ে বাংলা ব্যাকরণের বারোটা বাজানো হচ্ছে।”

মুক্তি সংগ্রামের বীর যোদ্ধা ছিলেন আনিসুজ্জামান। এক দিকে তিনি নিজে ভারতে বাস করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নানা উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন, অন্য দিকে, ভারতীয় নাগরিক সমাজের সহযোগের কথাও স্বীকার করেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে: “ভারতীয় বেসরকারি উদ্যোগও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে আগস্ট মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সাফল্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে বাংলাদেশেরও একটি বড় প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশ সহায়ক পরিষদের কাজও খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল।”

ক্রমশ বলদর্পী ও এককেন্দ্রিক পরিপার্শ্বে আনিসুজ্জামান ‘বলার স্বাধীনতা, জানার স্বাধীনতা’ প্রত্যাশা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য, যদি তা অমানবিক হয়। নারীর অবস্থান ও অগ্রগমনকে তিনি ইতিহাসের আলোকে দেখতে চান ‘উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির দৃষ্টিতে নারী’ প্রবন্ধে। বনফুলের পশ্চাৎপট ও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তাঁর মনোযোগ ও আলোচনা লাভ করে রচনা ও রচয়িতার জীবন ও সৃষ্টির প্রতি অপার আগ্রহে। ভারতীয় সাহিত্যতত্ত্ব, প্রকৌশলবিদ্যা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, বিংশ শতাব্দী থেকে গিরিশ ঘোষের অভিনয়কলা— এমন বিচিত্রবিধ বিষয়ে তাঁর প্রসারিত ভাবনা-ভুবন আমাদের ঋদ্ধ করে।

এ বইয়ের শ্রেষ্ঠ রচনা, বোধ করি, ‘জীবনে আমার কোনো খেদ নেই’ শীর্ষক অশীতিবর্ষ পূর্তিতে প্রদত্ত অভিভাষণ। তাঁর অমূল্য কথাতেই শেষ করা যাক এ লেখা: “আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, সে ক্ষেত্রে প্রাপ্যের অধিক লাভ করেছি। আমি সারা জীবন ছাত্র থাকতে চেয়েছিলাম, আমার যথাসাধ্য শিখতে চেষ্টা করেছি। জীবনে চলার পথে অপ্রত্যাশিত আঘাত যে পাইনি, তা নয়, কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি। আমার খেদ থাকার কথা নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE