উত্তরবঙ্গে তিস্তার ডান তীরের উপনদীগুলির মধ্যে অন্যতম করলা। আদরের নাম ‘কল্লা’। সমরেশ মজুমদারের লেখায় যেমন বার বার উঠে এসেছে চা-বাগান, খুঁটিমারির জঙ্গলের কথা, তেমনই এসেছে তিস্তা, আংরাভাসা, করলা নদীর নামও। তিনি লিখেছিলেন জলপাইগুড়িতে তাঁর হাকিমপাড়ার পাড়ার বাড়ি থেকে পা বাড়াতেই এক দিকে তিস্তা, অন্য দিকে করলা। করলায় ঠাকুর-ভাসানের অপরূপ অভিজ্ঞতা উঠে এসেছিল তাঁর লেখনীতে। বাঙালি পাঠক তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নতুন ভাবে পরিচিত হলেন চা-বাগানের জীবনের সঙ্গে, সেই জীবনকে দু’হাতে আঁকড়ে রাখা নদীগুলির সঙ্গে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের গণ্ডির বাইরে ক’জন আজ ‘জলপাইগুড়ির টেমস’ করলা নদীকে মনে রেখেছে? এক কালে সোনারঙা বালি বুকে বয়ে চলা ‘বালি সোনা’, এ কালের বালাসনের সঙ্গেই বা তাদের পরিচয় কতটুকু?
অথচ, এই বঙ্গ নাকি নদীবিধৌত। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গের জনজীবন, জীবিকা জুড়ে থাকা প্রধান নদীগুলি তো বটেই, অসংখ্য ছোট-বড় নদী বয়ে গিয়েছে এই রাজ্যকে চিরে। কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে, আর অনেকখানি দীর্ঘ প্রশাসনিক অবহেলায়, অপদার্থতায় তাদের অধিকাংশের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে। নদী থেকে আমরা শুধু নিয়েই গিয়েছি, তার অতীত গৌরব, সম্মান কোনও কিছুই ফিরিয়ে দিইনি। তাই হয়তো আজ আমাদের সঙ্গে নদীর এমন বিপুল ব্যবধান রচিত হয়েছে। বাড়ির কাছের নদীটি— সে যে বড় অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থাকে, শুকিয়ে কাঠ হয়, তার খবর আমরা কেউ কি রাখি?
সেই নদনদীদের নিয়েই সুপ্রতিম কর্মকার লিখেছেন এই বইটি। বইয়ের দু’টি ভাগ, প্রথম ভাগে আলোচিত হয়েছে জলের সৃষ্টি, নদ ও নদী কারা, নদীর ভাষার মতো বিষয়। দ্বিতীয় ভাগে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার আটাশটি নদনদীর উপকথা। তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঝুলি ভর্তি করে এনেছেন নদীর সঙ্গে জুড়ে থাকা নানা গল্প, উপকথা। সেই পরিপূর্ণ ঝুলি উপুড় হয়েছে এই বইয়ের পাতায়। ভূমিকায় বলেছেন— শরীরের বিশালতা, জলের তীব্রতা, স্রোতের ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে যে সব নদী প্রাচীন সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে, তাদের নিয়ে বেশি চর্চা হয়। তবে লোকজীবনের সঙ্গে ছোট নদীগুলি কী ভাবে মিশে ছিল, তা খুঁজতে গেলে আমাদের লোকজীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা উপাদানকেই খুঁজতে হয়। এমনই এক উপাদান উপকথা।
জলের ইতিকথা নদীর উপকথা
সুপ্রতিম কর্মকার
২৫০.০০
ধানসিড়ি

করলা নদীর লোককাহিনিটি যেমন ভারী মধুর। করলা আর রুকরুকা দুই ভাই-বোন। করলা দিদি আর রুকরুকা ছোটভাই। করলার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের দিনই তাদের বাবা মারা যান। বিয়ে আটকে যায়। এর কিছু দিন পর তাদের মা করলা ও রুকরুকাকে এক জঙ্গলে ফেলে রেখে আসেন। কিন্তু ফেরার পথে তাঁকে বাঘ খেয়ে নেয়। দুই ভাই-বোন তখন তিস্তাবুড়ির কাছে যায়, কান্নাকাটি করে, নিজেদের দুঃখের কথা বলে। তিস্তাবুড়ি আশীর্বাদ করেন তাদের নদী হয়ে বয়ে যাওয়ার। আর কথা দেন, তাদের দেখাশোনা করার। দুই ভাই-বোনের নাম থেকেই তৈরি হয় দুই নদ ও নদী।
আর এক নদী অঞ্জনা। আগে তার নাম ছিল ক্ষীরাবতী। ক্ষীরাবতী, ক্ষীর নদী। নদীর ধারে এক কাঁসারির বাড়িতে ছোট্ট মা-মরা মেয়ে অঞ্জনা। অঞ্জনা এক দিন যায় ক্ষীর নদীতে সাঁতার কাটতে। কিন্তু ক্ষীর নদীতে জলের ঘূর্ণিপাকে পা আটকে অঞ্জনার মৃত্যু হয়। তার পর থেকে এই নদীর নাম হয় ‘অঞ্জনার ক্ষীর নদী’। কালক্রমে ক্ষীর নদী নাম হারিয়ে পড়ে থাকে শুধুই অঞ্জনা। নদীর নামের সঙ্গে জুড়ে থাকে কখনও তার উৎসের খোঁজ, আবার কখনও লোককাহিনির চরিত্রেরা। সেই লোককাহিনিকে হারিয়ে ফেলা মানে নদী হয়ে যায় পরিচিতিহীন, নিঃসঙ্গ। উল্টোটাও সত্যি। নদীকে হারিয়ে ফেলা মানে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা চরিত্রগুলিকেও তো হারিয়ে ফেলা, মুছে যাওয়া নদীর আশপাশের বিস্তীর্ণ জায়গার কতশত বছরের আর্থ-সামাজিক চিত্র।
উপকথা সংগ্রহের কাজটি সহজ নয়। কেন নয়, বইয়ের ভূমিকায় স্বয়ং লেখকই তা তুলে ধরেছেন। উষ্ণায়নের দাপটে ক্রমশ শুকিয়ে আসছে ছোট নদীগুলি, যেখানে তিরতিরে জল ছুঁয়ে যেত দুই পাড়, সেখানে বাড়ছে চরের দাপট। বিপজ্জনক মাত্রায় নামছে ভূজলের ভান্ডারও। এই পরিস্থিতিতে ‘জল’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা একান্ত প্রয়োজন। বইটি সেই ভাবনার গোড়ায় খানিক তাজা বাতাস জুগিয়ে গেল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)