Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার বহুমুখী প্রয়াস

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্র ও ‘স্ত্রী’র উদ্যোগে প্রকাশিত উনিশ ও বিশ শতকের বাংলায় মহিলাদের রচিত প্রবন্ধের সংকলনটি নিঃসন্দেহে বৃহত্তর পাঠকসমাজ ও গবেষকদের কাছে বঙ্গনারীর চিন্তা-চেতনার বহুধাবিস্তৃত জগৎটিকে তুলে ধরার এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। ইপ্সিতা চন্দ ও জয়িতা বাগচী বিপুল পরিশ্রমে প্রায় চারশো পাতার যে সংকলনটি তৈরি করেছেন তা নারী ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয় আকর হয়ে থাকবে। জানালেন সারদা ঘোষ।

শেপিং দি ডিসকোর্স/ উইমেন্স রাইটিংস ইন বেঙ্গলি পিরিয়ডিক্যাল্স (১৮৬৫-১৯৪৭), সম্পা: ইপ্সিতা চন্দ ও জয়িতা বাগচী। স্ত্রী, ৫৫০.০০

শেপিং দি ডিসকোর্স/ উইমেন্স রাইটিংস ইন বেঙ্গলি পিরিয়ডিক্যাল্স (১৮৬৫-১৯৪৭), সম্পা: ইপ্সিতা চন্দ ও জয়িতা বাগচী। স্ত্রী, ৫৫০.০০

সারদা ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্র ও ‘স্ত্রী’র উদ্যোগে প্রকাশিত উনিশ ও বিশ শতকের বাংলায় মহিলাদের রচিত প্রবন্ধের সংকলনটি নিঃসন্দেহে বৃহত্তর পাঠকসমাজ ও গবেষকদের কাছে বঙ্গনারীর চিন্তা-চেতনার বহুধাবিস্তৃত জগৎটিকে তুলে ধরার এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। ইপ্সিতা চন্দ ও জয়িতা বাগচী বিপুল পরিশ্রমে প্রায় চারশো পাতার যে সংকলনটি তৈরি করেছেন তা নারী ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয় আকর হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে বাঙালি মহিলাদের লেখা ৬৫টি প্রবন্ধ সংকলন করাই নয়, সেগুলিকে ভাবগত সাযুজ্যের ভিত্তিতে যে চারটি আলাদা বিভাগে তাঁরা সম্মিলিত করেছেন তা থেকে ১৮৬৫-১৯৪৭ কালপর্বে বঙ্গনারীর পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বিষয়টি আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে।

সংকলনটির ভূমিকাতেই দুই সম্পাদক, বিশেষত ইপ্সিতা চন্দ তাঁর রচনায় ‘নারীদের প্রশ্ন’ বিষয়টিকে বৃহত্তর লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ভাবনার পরিসরে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। যে কোনও ভাবনা বা ধারণার অন্তর্নিহিত নির্যাস ও তার সামাজিক প্রভাব কী ভাবে প্রায় একশো বছরের দীর্ঘ সময়কালে বাঙালি মহিলাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছিল তা বোঝাতে গিয়ে প্রবন্ধ সংকলনটিতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় জনগোষ্ঠীরই শিক্ষিত নারীমননের অনুসন্ধান করা হয়েছে। যেমন, বিবি তেহেরুন্নিসা তাঁর প্রবন্ধে নারীজীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে যে ভাবে পুরুষশাসিত সমাজের প্রচলিত নেতিবাচক ভাবনাগুলিকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন বা যে ভাবে তিনি নারীশিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে প্রাচীন হিন্দু মহিলাদের উদাহরণও দিয়েছেন, তাতে জাতি বা ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও নারীর অবস্থানগত পরিবেশ ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য বাঙালি নারীর আন্তরিক আগ্রহ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। আবার বিশ শতকের বাঙালি মহিলারা বেশ কিছু প্রবন্ধে (বিশেষত প্রবন্ধ নং ৫০, ৫১, ৫৪) যে পরিণত চিন্তার প্রমাণ তাঁদের রাজনীতি বিষয়ক ভাবনায় তুলে ধরেছেন তাতে লিঙ্গভিত্তিক সমাজে নিজেদের পরিচিতি অনুসন্ধানের তাগিদটি স্পষ্ট। পাশাপাশি জনজীবনে পুরুষদের মতো দায়িত্ব ও কর্তব্য তথা সচেতনতার অংশীদার হিসেবে নিজেদের ভূমিকাকে তুলে ধরতে বঙ্গমহিলাদের যোগ্যতাও এক ভাবে এই লেখাগুলির মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করা যেতে পারে। যে সব বহুবিচিত্র প্রবন্ধ এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে দিয়ে বঙ্গনারীর ভাবনার পরিপক্বতা, পরিমার্জনা, পুরুষশাসিত সমাজের সঙ্গে রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক এক জটিল সম্পর্কের বিন্যাস, সব কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়।

মুসলিম মহিলাদের শিক্ষালাভের প্রতি আগ্রহ, শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক অবরোধের গণ্ডি অতিক্রম করা অথবা নিজস্ব সমাজনির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে আত্মপরিচিতি অনুসন্ধানের তাগিদকে বিবৃত করার ক্ষেত্রে প্রবন্ধগুলির (প্রবন্ধ নং ১, ১৪, ২২, ২৩, ৩৮, ৪০, ৫৭, ৬৩) নির্বাচন যথেষ্টই যথাযথ হয়েছে। বিশেষত আলোচ্য সময়ে শিক্ষিত মুসলিম নারীসমাজও যে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এমনকী নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ ও বিবেচনা করার যোগ্যতা অর্জন করেছিল তার কিছু ইঙ্গিত এখানে মেলে। রাজনীতি ও নারীর কর্মসংস্থান এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই সম্পাদিকা যে সব প্রবন্ধ এই সংকলনে রেখেছেন, তা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। বঙ্গমহিলাদের শিক্ষা ও তার উপযোগিতা, পারিবারিক জীবন থেকে বৃহত্তর জনজীবনে আত্মপ্রকাশ অথবা আত্মপ্রতিষ্ঠার ভাবনা নিয়ে যে ধরনের আলোচনা বা গবেষণা অদ্যাবধি হয়েছে বা এখনও চলছে তাতে নারীর রাজনৈতিক মনন ও কর্মক্ষেত্র নির্বাচনের বিষয়গুলি অবশ্যই স্বতন্ত্র বিশ্লেষণের দাবিদার। সে কাজে এই প্রবন্ধগুলি নিশ্চয়ই সহায়ক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। বিশেষত ৬১ নং প্রবন্ধে লীলাবতী রায় যে ভাবে গাঁধীর নারীবাদী ভাবনা আবার নারীর কর্মসংস্থান ও যোগ্যতার বিষয়ে তাঁর রক্ষণশীল মনোভাবের সমালোচনা করেছেন তাতে সমাজনিহিত লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে নতুন এক ক্ষেত্রের আত্মপ্রকাশের ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। ৪৬ ও ৪৭ নং প্রবন্ধে যথাক্রমে স্বর্ণলতা বসু ও মনোরমা বসু ভারতীয় মহিলাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়টিকে আলোচনার পরিসরে এনে নতুন সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অবস্থানকেও সুনিশ্চিত করার পক্ষে জোরাল বক্তব্য জানিয়েছেন। আবার ৪৮ নং প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য ভারতের নারী আন্দোলন। এ ভাবে শিক্ষিত মহিলাদের চিন্তা-চেতনার বহুমুখীনতা এই নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলনের মূল ভাবনাকে অনেকটাই পরিপুষ্ট করেছে।

সংকলিত প্রবন্ধগুলির রচনার কালপর্ব বাংলায় বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাক্ষী। অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এমনকী চিন্তা-চেতনার রূপান্তরের এই পর্বে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, নারীর পারিবারিক তথা সামাজিক অবস্থানও নানা ভাবে প্রভাবিত হচ্ছিল। একদা যে পুরুষতান্ত্রিকতার নিয়মনীতি নারীর অধিকারের সীমারেখা নির্ণয় করেছিল, জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশীয় নারীসমাজের একাংশ সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াসও নানা ভাবে শুরু করেছিল। কখনও তা সরাসরি আক্রমণাত্মক লেখনীর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, কখনও বা সমঝোতার মধ্যে দিয়ে তা নতুন পথের সন্ধান করেছে। বঙ্গনারীর চিন্তাচেতনার এই বহুমুখীনতাকে নারীশিক্ষার সূত্র ধরে বিশ্লেষণের যে চেষ্টা জয়িতা বাগচী ভূমিকার দ্বিতীয় অংশে করেছেন তার মধ্যে দিয়েও ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতার ভাবনার সংঘাত, নারীজীবনের আত্মিক ও বাহ্যিক রূপান্তরের বৈশিষ্টগুলি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ভূমিকায় আলোচ্য সময়কালে এই রূপান্তরের অন্য ধারাগুলিকে আলোচনা করলে একই সঙ্গে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এবং তার মধ্যে বঙ্গনারীর চিন্তা-চেতনার বহমানতাকে হয়ত আরও স্পষ্ট ভাবে বিশ্লেষণ করা যেত।

সূচনায় দুই সম্পাদিকা এই শ্রমসাধ্য প্রয়াসের মূল উদ্দেশ্যটিকে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নিছক নারীর জীবন ও ভাবনার বিবরণ নয়, আলোচ্য প্রবন্ধগুলির মধ্যে দিয়ে সমাজে অন্তর্নিহিত নারী-পুরুষ সম্পর্কের সমীকরণ, টানাপড়েন এমনকী ক্ষমতায়নের মেরুকরণ অনুসন্ধানের একনিষ্ঠ প্রয়াস প্রশংসনীয়। কিন্তু এই বৈচিত্রপূর্ণ সম্পর্ক ও অধিকারের জটিলতাকে হয়ত আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝা যেত যদি মহিলাদের রচনার পাশাপাশি তৎকালীন শিক্ষিত পুরুষ সমাজের লেখাও সংকলনে স্থান পেত। কারণ সামাজিক ক্ষমতা নির্ণয়ের প্রশ্নে উভয় ক্ষেত্রেরই নিজস্ব ভাবনাগত বৈশিষ্ট সক্রিয় ছিল। বাংলার অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকপত্র থেকে প্রবন্ধগুলি সংকলন করা হয়েছে, কিন্তু যে ভাবগত ব্যঞ্জনার ভিত্তিতে সেগুলি বাছা হয়েছে সেই জাতীয় ভাবনার অনুরণন সে সময়ের আরও অনেক পত্রপত্রিকাতেই লক্ষ করা যায়। হয়ত সময় ও আয়তন উভয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই সম্পাদিকারা তাঁদের গ্রন্থটিকে বর্তমান রূপ দিয়েছেন। ভবিষ্যতে অন্যান্য পত্রপত্রিকা থেকে এমন আরও প্রবন্ধ সংকলন করে তাঁরা নারী-ইতিহাস ও লিঙ্গভিত্তিক চিন্তা-চেতনার বিবর্তনকে নিশ্চয়ই আরও সমৃদ্ধ করবেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE