Advertisement
E-Paper

আপনভোলা হোক বা ডাকসাইটে, জামাইয়ের কেতা কিন্তু থাকবেই

সুগার-কোলেস্টেরলে জর্জরিত শ্বশুরকে সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি উপহার দিলে তিনি কি খুশি হবেন না?

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৮ ১০:০৪
 অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

জামাইষষ্ঠী বাংলা ও বাঙালির একটি প্রাচীন পার্বণ। মেয়ের বরকে নিয়ে এমন হুলুস্থূল কাণ্ড, এমন একটি চমৎকার লোকাচার ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর অন্য কোনও জাতির জনজীবনে সেই ভাবে কিন্তু লক্ষ্য করা যায় না। জ্যৈষ্ঠ মাসের যে দিনটিতে জামাইষষ্ঠী, সে দিন আসলে মা ষষ্ঠীর পুজো। মা ষষ্ঠী এই চরাচরের গেরস্ত বাঙালির সন্তানদের আদর-যত্নে রক্ষা করে থাকেন। একটি কাঁসার থালায় পান, সুপুরি, ধান, দুব্বো, আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু এমন সব গরমকালের ফল, সুমিষ্ট দধি, কিছু বনেদি মিষ্টান্ন আর হাওয়া করার জন্যে লাল রঙের ফ্রিল আঁটা একটি সুন্দর হাতপাখা— এগুলোই হল ষষ্ঠীঠাকরুণের তথা জামাইপুজোর কিছু কমন উপাচার। আহা! জামাইও তো শাশুড়িমায়ের সন্তানেরই মতো। তাকে আদরযত্ন করলে বাড়ির মেয়েটাও তার শ্বশুরবাড়িতে আদরযত্ন পাবে, দুধটা-মাছটা পাবে— এই ভাবনা থেকেই হয়তো এ হেন আচারের সূত্রপাত হয়েছিল।

আমরা মুখে যতই বলি, মেয়ের বাড়ি আর জামাইয়ের বাড়ি এক, সত্যিকারের জীবনে কিন্ত এদের মধ্যে একসুতো হলেও ফারাক থেকে যায়। জামাই, সে গ্রামের হোক বা শহরের, ডাকসাইটে হোক বা আপনভোলা, ডাক্তার হোক বা কেরানি, ইংলিশ মিডিয়াম হোক বা বাংলা মিডিয়াম, মিষ্টিপ্রিয় হোক বা সুগার-ফ্রি, নিজবাটী হোক বা ঘরজামাই— তার একটা আলাদা কেতা কিন্তু থাকবেই। আর তার মধ্যে এই কেতাটা থাকুক, এটা মুখে না-বললেও মেয়ের বাড়ির সক্কলেও কিন্তু আশা করে।

যদিও বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর থেকে, এই কেতাটাকে পোষা টিয়াপাখিটির মতো রোজ চাড্ডি ভিজেছোলা খাওয়ানোর ফলে, জামাইবাবাজি এবং তার আত্মীয়পরিজন, গর্ব ও অহঙ্কার মিশিয়ে সব সময়েই কেমন যেন একটু টুসটুসে হয়ে থাকেন। মেয়েপক্ষের সামান্য আলটপকা কথায় তাঁদের মন যেন অভিমানে পালক ফোলায়। হয়তো কোনও তুচ্ছ কারণ, যাকে অতটা গুরুত্ব না-দিলেও হয়তো কিছু আসত-যেত না, কিন্তু তাঁরা গুরুত্ব দিলেন, মনে করলেন, পালক ফোলালেন এবং পুরো কেতাটা দেখিয়ে ছাড়লেন। দু’টি বাড়ির মধ্যে জমে থাকা কোনও গুমোট হাওয়া কিংবা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দেওয়ার জন্য, জামাইয়ের গোমড়া মুখটিকে হাসিহাসি করে দেওয়ার জন্য জামাইষষ্ঠী নামক পরবটির কোনও তুলনা নেই। নতুন এবং মোটামুটি দু’-তিন বছরের টাটকা জামাইকে, শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠী করতে আসার জন্যে, তত্ত্ব-সহ নেমন্তন্ন করে আসার চল আছে। আর এক বার তাকে বাড়িতে এনে ফেলতে পারলে কেল্লা ফতে। তাই বাঙালির অতি আধুনিক ও দ্রুতগামী জীবন থেকে কিছু কিছু সুন্দর আচার-অনুষ্ঠান একে একে হারিয়ে গেলেও, জামাইষষ্ঠীর মতো উৎসব এখনও হারিয়ে যায়নি, তবে অবশ্যই তার রূপবদল ঘটেছে।

আগে কাকভোরে উঠে শাশুড়িমা রান্নার জোগাড় শুরু করতেন। মাটির তৈরি বিরাট জোড়া-উনুনে গুল-কয়লা দিয়ে, খেজুর পাতা দিয়ে যত্ন করে উনুন ধরিয়ে কুটনো-কোটা, বাটনা বাটা শুরু করতেন। জামাইয়ের জন্য বিশেষ মাপের কাঁসার তৈরি থালা-বাটি-গেলাস বের করে, সেগুলো তেঁতুল আর শালপাতা দিয়ে মেজে-ধুয়ে ঝকঝকে করে রাখতেন। আর শ্বশুরমশাই-সহ বাড়ির বয়স্ক কত্তারা কেউ ছুটতেন রেওয়াজি খাসি বা তাগদদার পাঁঠার খোঁজে, কেউ যেতেন পুকুরের রুই-কাতলা ধরার তদারকি করতে, আবার কেউ দৌড়তেন গরুর ঘন দুধ চোখের সামনে দুইয়ে আনার জন্য— যা দিয়ে সে দিন বাবাজীবনের জন্য কাজু-কিসমিস গিসগিসোনো কামিনীভোগ আতপের সুগন্ধি পায়েস তৈরি হবে। পরের দিকে এই রান্নাবান্নার ঝক্কিটা বাড়ির পুরনো বামুনঠাকুররা সামলাতেন। শাশুড়ি ঠাকরুণরা থাকতেন তদ্বির তদারকিতে।

কালে কালে বাড়িতে রান্নার পাট একদম তুলে দিয়ে কিছু আধুনিক শাশুড়ি বেছে নিলেন কয়েকটি নামকরা বাঙালি রেস্তরাঁর স্পেশাল ‘জামাইষষ্ঠী থালি’। সেখানে হৃদয়ের ভালবাসা ও পকেটের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে আমিষ-নিরামিষ-ডেজার্ট মিলিয়ে ৭টি থেকে ২০টি পর্যন্ত পদ সার্ভ করার ব্যবস্থা রয়েছে। কোনও কোনও তারকাশোভিত রেস্তরাঁয় দেখা মেলে স্পেশাল ‘জামাইবরণ বুফে’র। এই বিশেষ দিনটিতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে আসা জামাইরা শ্বশুর-শাশুড়ির অনাবিল স্নেহচ্ছায়ায় এই চমৎকার বুফে থেকে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় খাবার যেটা খুশি যত খুশি খেয়ে মন ও পেট দুইই ভরাতে পারেন। এক বার কলকাতার এক মস্ত বড় বাঙালি রেস্তরাঁর মালিকের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে বলেছিলাম, জামাইষষ্ঠীর দিনের ট্র্যাডিশনাল বাঙালি পদগুলোর নাম তারা শাশুড়িদের নামে রাখে না কেন? সে ব্যাপারটা পরিষ্কার না বোঝায় উদাহরণ দিয়েছিলাম, ‘মাসশাশুড়ির হাতের ভেটকিপাতুরি’, ‘পিসশাশুড়ির হাতের দই-ইলিশ’ এই রকম আর কী! তা, আমার সাজেশনটা তার খুবই মনে ধরেছিল। কিন্তু সত্যিই ওই পদগুলোর নাম ওই ভাবে রাখা হয়েছে কি না তা আমার জানা হয়নি।

এমন দিনেও ক্যালোরি কাউন্ট! অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

আজকালকার হাইপ্রোফাইল জামাইরা আপিস থেকে ছুটিছাটা পায় না বললেই চলে। ডায়েট প্ল্যানের চক্করে তাদের খাওয়াদাওয়াও খুব ক্যালরি মেপে। আগেকার দিনের মধ্যবিত্ত জামাইদের মতো তাদের সেজেগুজে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার বা বাবু হয়ে পেটপুরে খাওয়ার কোনও জো নেই। কিছু দিন আগেও জামাইষষ্ঠীর দিন সকালে ধুতি-পাঞ্জাবি-আংটি-বোতাম পরে, এক হাতে মিষ্টির বিরাট হাঁড়ি আর অন্য হাতে একটা বিরাট ইলিশমাছ মুখে সুতো বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গিন্নির সঙ্গে তার বাপের বাড়িতে চলেছে— এমন জামাই আমি প্রচুর দেখেছি। সেই সব জামাই জানুয়ারি মাসে পাওয়া নতুন দোভাষী-ক্যালেন্ডারে, জামাইষষ্ঠীর দিনটি আলাদা করে লাল ডটপেন দিয়ে গোল করে রাখত। এ দিন অন্য কোনও কাজ তারা পারতপক্ষে রাখত না। এখনকার জামাইরা নিজে নিজে ধুতি পরতে পারে না, তাই পাজামা-পাঞ্জাবিই চলে বেশি। কর্পোরেট জামাই হলে অবশ্য সে দিনটাও প্যান্ট-শার্ট-টাই। সকালবেলায় শ্বশুর হয়তো জামাইয়ের সোশাল মিডিয়া সাইটের টাইমলাইনে ঢুকে পাবলিক পোস্ট দিলেন, ‘হ্যাপি জামাইষষ্ঠী। গড ব্লেস!’ জামাই সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করল, ‘ড্যাড, পোস্টটা প্লিজ পাবলিক থেকে রেস্ট্রিকটেড করুন। আমার ইমিডিয়েট বস লাস্ট উইকেই ডিভোর্স পেয়েছে।’

আগে শ্বশুরবাড়ি কাছাকাছি হলে ছাপোষা জামাই সপরিবার উঠে পড়ত টুং-টুং হাতরিকশায়। উঠে মাথার ওপরকার তেরপলের ছাউনি টেনে দিত। তার পায়ের কাছে রাখা থাকত মাছ এবং মিষ্টির হাঁড়ি। আর শ্বশুরবাড়ি কিঞ্চিৎ দূরে হলে তখন হয়তো ট্রাম কিংবা বাস। গ্রাম বা মফসসলে যেতে হলে হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কু-ঝিক-ঝিক ট্রেন। আগে, কলকাতার মধ্যবিত্ত বাড়ির সরকারি চাকুরে জামাইরা এই বিশেষ দিনটিতে ট্যাক্সি করে নিজের গিন্নিকে বাপেরবাড়ি নিয়ে যেত। নিজে বসত সামনের সিটের জানলার ধারে, বাঁ-হাতের অর্ধেকটা কনুই বাইরে বার করে। পরিবার এবং ছানাছানিরা বসত পিছনে। টুকটুকে লাল ডবল-ডেকার বাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিজের মাথাটা একটু ডানদিকে হেলিয়ে পঞ্জাবি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যথাসম্ভব ভারী গলায় বলত, ‘থোড়া জলদি চলিয়ে সর্দারজি!’ তারপর গিন্নির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসত।

যারা প্রবাসী জামাই তারা ইচ্ছে থাকলেও ফি বছর জামাইষষ্ঠীতে দেশে আসতে পারে না। কিন্তু যে বার আসে, সে বার কয়েক বছর বন্যা না-হওয়া মাতাল নদীর মতো দু-কূল একদম ভাসিয়ে দেয়। কী করে তার যথাযোগ্য খাতির করা যায়, সারাদিন এই ভেবে ভেবেই তার শাশুড়িমা অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোন ব্র্যান্ডের জামা তার পছন্দ, কী ধরনের ট্রাউজার তাকে সুট করে, কোন কোন খাবার তার ভাল লাগে আর কীসে কীসে তার অ্যালার্জি— নিজের মেয়ের কাছে সেই সব ফিরিস্তি জানতে জানতেই তো তাঁর সারা রাত কেটে যায়।

আবার জামাইবাবাজিও ভাবতে থাকে, তার শ্বশুর-শাশুড়িকে এই দিনটিতে কী উপহার দিলে তাঁরা সবচেয়ে খুশি হবেন। তাঁদের কারও গার্ডেনিংয়ের শখ থাকলে ভাল নার্সারি থেকে উপহার দেওয়া যায় একটি সুন্দর ফুল বা ফলের গাছ। সদ্য মোবাইল ফোনে হাত-পাকানো শাশুড়িকে দেওয়া যেতে পারে ট্যাবলেটের মতো কোনও ইলেকট্রনিক গেজেট। রকমারি রান্না করে সবাইকে চমকে দেওয়ার শখ থাকলে উপহার দেওয়া যায় রান্না করার আধুনিকতম উপকরণ। ছবি আঁকার শখ থাকলে উপহার দেওয়া যায় রং-তুলি-আঁকার খাতা। পুরনো গান শোনার শখ থাকলে গিফট করা যেতে পারে একটি বিশেষ ধরনের রেডিও, যার মধ্যে লোড করা রয়েছে স্বর্ণযুগের কয়েক হাজার গান। তবে প্রেসার-সুগার-কোলেস্টেরলে জেরবার কোনও শ্বশুরমশাইকে তাঁর ঝকঝকে জামাই যদি দিনের শেষে একটি সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি উপহার দ্যায়, তবে তার থেকে খুশি তিনি বোধহয় আর কিছুতেই হন না!

bengali festival Jamai sasthi special
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy