Advertisement
E-Paper

সোনার অঙ্গ গৌরাঙ্গ জামাই-পাতে খান পনির পসন্দ

জামাইষষ্ঠীর দিনে তিনি মহাপ্রভু মন্দিরের সেবাইতদের কাছে ‘জামাতা’। ঘরের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বামী। ‘বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণধন’ সে দিন সারা নবদ্বীপের মানুষের চোখে জামাই হিসেবেই আদর পেয়ে থাকেন। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ১২:৩০
জামাইষষ্ঠীতে মহাপ্রভুর রাজভোগ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

জামাইষষ্ঠীতে মহাপ্রভুর রাজভোগ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

বছরের আর পাঁচটা দিন তিনি ধামেশ্বর মহাপ্রভু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। কেবল জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী অর্থাৎ জামাইষষ্ঠীর দিনে তিনি মহাপ্রভু মন্দিরের সেবাইতদের কাছে ‘জামাতা’। ঘরের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বামী। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাইয়ের বংশের উত্তরপুরুষেরা বংশ পরম্পরা মহাপ্রভু মন্দিরের সেবা পুজোর অধিকারী। সারা বছর ভোর থেকে রাত ঘড়ির কাঁটা ধরে হয় তাঁর ‘আত্মবৎ’ নিত্যসেবা। তখন তিনি ভক্তের ভগবান।

জামাইষষ্ঠীর দিন সেই দেবতাই হয়ে ওঠেন প্রিয়। এ দিন প্রতি পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয় গৃহত্যাগী শ্রীচৈতন্যদেব গোস্বামীদের ‘জামাইরাজা।’ গোটা দিনের পুজোর মধ্যেই প্রকাশ পায় জামাই আদর। ‘বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণধন’ সে দিন সারা নবদ্বীপের মানুষের চোখে জামাই হিসেবেই আদর পেয়ে থাকেন। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি।

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাইয়ের উত্তরপুরুষ তথা মহাপ্রভুর সেবাইত গোস্বামী পরিবারের প্রবীণ সদস্য লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “যতটুকু জানি, ষষ্ঠীদাস গোস্বামীর আমল থেকে জামাইষষ্ঠী পালন শুরু হয়েছিল মহাপ্রভু মন্দিরে। ষষ্ঠীদাস ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাই মাধবাচার্যের অধস্তন তৃতীয় পুরুষ। অর্থাৎ প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা।” আর কোথাও মহাপ্রভুকে এ ভাবে সেবা করা হয় না। দাবি মহাপ্রভু মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সেবাইতদের।

বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী জানান, ভোর সাড়ে পাঁচটায় মঙ্গলারতি কীর্তনে আর পাঁচ দিনের মতোই গাওয়া হয়, ‘‘উঠো উঠো গোরাচাঁদ নিশি পোহাইলো, নদিয়ার লোক সবে জাগিয়া উঠিল...’’। কিন্তু এর পর দিনভর সবই অন্য রকম। ভোগের পাত্র এবং পদ সবই এ দিন সকাল থেকেই বদলে যায়। রুপোর রেকাবিতে মরসুমি ফল, রুপোর বাটিতে ক্ষীর, রুপোর গ্লাসে জল। একটু বেলা গড়াতেই বাল্যভোগ। প্রবীণ মহিলারা মহাপ্রভুকে ষষ্ঠীর ‘বাটা’ দেন। কেউ কেউ বলেন ‘ষাট’ দেওয়া। আম, দূর্বা, বাঁশের পাতা, লাল সুতো দিয়ে তালপাখার হাত পাখায় বেঁধে ‘ষাটের’ বাতাস করেন আর ছড়া কাটেন “জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাইষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট/ ভাদ্র মাসে চাপড়াষষ্ঠি ষাট ষাট ষাট...।’’ এ ভাবে বারোমাসের সব ষষ্ঠীর নাম করে ছড়া বলা শেষ হলে ভোগ দেওয়া হয় ফলার। চিড়ে, মুড়কি, দই, আম, কাঠাল এবং নানা মিষ্টি।

মহাপ্রভুকে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবিতে সাজানো হয় জামাই বেশে। পরানো হয় রজনীগন্ধা, গোলাপের মালা। গায়ে আতর। এই প্রজন্মের সেবাইত সুদিন গোস্বামী জানান, আগের দিনে যখন দোকানের মিষ্টি সহজে মিলত না, তখন সেবাইত পরিবারের মহিলারা মহাপ্রভুর জন্য এ দিন বিশেষ ছাঁচের মিষ্টি তৈরি করতেন। নারকেল কোরার সঙ্গে ক্ষীর, এলাচ কাজু, কিসমিস মিশিয়ে গুড় দিয়ে পাক করতেন। সেই পাক কাঠের ছাঁচে ফেলে ফুল, নকশা, পাখি, ছোট মন্দির আকারের মিষ্টি গড়তেন।

হেঁশেল: চলছে মহাপ্রভুর জামাইষষ্ঠীর রান্না

এর পর মধ্যাহ্ন ভোগ। মহাপ্রভুর জামাইষষ্ঠী বলে কথা। মেনুতে কী থাকে, তা বলার থেকে কী থাকে না বলা সহজ। প্রতি দিনের ভোগে কচু শাক, মোচা, শুক্ত থাকেই। এ দিন তার সঙ্গে থাকে নানা তরকারি, ডাল, ভাজা, থোড়, বেগুনপাতুরি, ছানার রসা (ডালনা), ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো থাকবেই। পোস্ত দিয়ে যত রকমের পদ সম্ভব সবই থাকে। পরিচালন সমিতির পুলক গোস্বামী জানান, সময়ের প্রভাব ভোগের পদেও পড়েছে। ‘পনির পসন্দ’-এর মতো আধুনিক পদও ঠাঁই পেয়েছে পুজোর মেনুতে। তবে এ দিনের একটি বিশেষ পদ হল আমক্ষীর। আমের রস ক্ষীরের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা হয় ওই বিশেষ পদটি। দেওয়া হয় নানা মশলা, কর্পূর দিয়ে সাজা সুগন্ধি পান।

বিকেল পাঁচটায় উত্থান ভোগ। রুপোর রেকাবিতে ছানা, মিষ্টি দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় নাটমন্দিরে বিশেষ পাঠ কীর্তন, আলোকসজ্জার আয়োজন। রাত ৯টায় শয়ন ভোগ। ঘিয়ের লুচি, মালপোয়া আর রাবড়ি। সঙ্গে আবার খিলি করে সাজা সুগন্ধি পান।

মহাপ্রভুকে নিজের সন্তানতুল্য মনে করে ‘বাটা’ বা ‘ষাট’-এর বাতাস দিতে এ দিন প্রচুর স্থানীয় মহিলা ভিড় করেন মহাপ্রভু মন্দিরে। আরাধ্য দেবতাকে পিতা, মাতা, সন্তান বলে পুজোর রীতি এ দেশে চিরকালের। তবে জামাই বলে দেবতাকে আপন করে নেওয়ার রীতি নবদ্বীপ ছাড়া বড় একটা দেখা যায় না।

শুধু দেবতার নয় সে কালের রাজা-মহারাজাদের জামাইষষ্ঠি গল্পের মতো শোনায়। ইতিহাস বিখ্যাত নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে জামাইষষ্ঠি পালন করা হত রাজকীয় আড়ম্বরে। সে কালে বঙ্গদেশে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা ছিল অত্যন্ত গর্বের বিষয়। ফলে এই পরিবারের অধিকাংশ মেয়েরই বিয়ে হত বাংলার অনান্য সম্ভ্রান্ত রাজপরিবারের সঙ্গে। জামাইরা প্রত্যেকেই ছিলেন কোনও না কোনও রাজবংশের সন্তান। এহেন জামাইরা যখন ষষ্ঠি করতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে আসতেন তখন তাদের আপ্যায়নের জন্য জাঁকজমকের বহর সহজেই অনুমান করা যায়।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অধস্তন সপ্তম পুরুষ মহারাজা ক্ষৌণিশচন্দ্রের অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী জ্যোতির্ময়ী দেবী দীর্ঘদিন নদিয়া রাজপরিবার প্রধান হিসেবে ছিলেন। তাঁদের দুই মেয়ে। জ্যোৎস্নাময়ী বড়। তাঁর স্বামী ছিলেন হেকমপুরের রাজা রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তী। ছোটমেয়ে পূর্ণিমা দেবীর স্বামী ছিলেন কালাজ্বরের ওষুধের আবিষ্কারক স্যার ইউ এন ব্রহ্মচারীর ছোট ছেলে নির্মল ব্রহ্মচারী। রাজবাড়ির বধূ অমৃতা রায় জানান, এমন নামীদামী জামাইদের যাতে যথাযথ সম্মান রক্ষা করা যায় তাঁর জন্য জ্যোতির্ময়ী দেবীর আয়োজনে কোনও ত্রুটি থাকত না। কার্যত পয়লা বৈশাখের পর থেকেই তাঁর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত জামাইষষ্ঠি নিয়ে।

ভোজনরসিক বলে নদিয়ারাজ পরিবারের সুখ্যাতি চিরকালের। সুখাদ্যের প্রতি অনুরাগের জন্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রীতিমতো খ্যাতি ছিল। ফলে জামাইষষ্ঠির মতো খাদ্য প্রধান উৎসবে রাজভোগের বিপুল আয়োজন হবে তা বলাই বাহুল্য। রাজবাড়ির উৎসব মাত্রেই খাওয়া দাওয়ার একটা বড় ভূমিকা থাকবেই। এটা নতুন কিছু নয়। বরং জামাইষষ্টিতে উপহারের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। জ্যোতির্ময়ী দেবীর আমল পর্যন্ত জামাইদের মূল্যবান সামগ্রী যেমন- রত্ন, অলঙ্কার, মহার্ঘ পোশাক উপহার দেওয়া হত জামাইদের। খাওয়াদাওয়াও কিছু কম হত না। পোলাও এবং কষা মাংস জামাইষষ্ঠির দিন রাজবাড়িতে হবেই। সঙ্গে প্রতি বছর কোন না কোন বিশেষ মেনু জামাইদের কল্যাণে প্রস্তুত করতেন জ্যোতির্ময়ী দেবী নিজে। তাতে কোন বার বিশেষ কোনও উপাদানের পায়েস তো কোনও বারে নতুন ভাবে রান্না করা মাংস অথবা পোলাওয়ের কোনও নতুন রেসিপি থাকত জামাইদের জন্য।

ঠাটবাটে রাজবাড়ির জামাইরাও কম যেতেন না। অমৃতাদেবী জানান, মহারাজ ক্ষিতিশচন্দ্র এবং কৃষ্ণনন্দিনীর মেয়ে ছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। তাঁর স্বামী বাবু ঋষিকেষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বৈঁচির রাজা। তাঁর ছিল পানের নেশা। নানারকম মশলা দিয়ে সাজা পান ঘন ঘন খাওয়া ছিল অভ্যাস। সে কালে সাজা পানের খিলি লবঙ্গ দিয়ে গেঁথে রাখার চল ছিল। কিন্তু বৈঁচির রাজামশাইয়ের পানের খিলিতে গাঁথা থাকত সোনার লবঙ্গ। তিনি পান খাওয়ার আগে সেই সোনার লবঙ্গ পানের খিলি থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পান খেতেন। আর রাজবাড়ির ছোটরা এ দিক ও দিক পড়ে থাকা সেই সব সোনার লবঙ্গ কুড়িয়ে নিত।

Bengali festival jamai sasthi celebration নবদ্বীপ চৈতন্যদেব
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy