বেহাল আবাসন। —নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যের সীমানায় এক টুকরো ছিমছাম জনপদ। আশপাশে খনিতে ভরা এলাকার মাঝে এক সময়ে এই জনপদ পরিচিত ছিল ইস্পাতের জন্য। সেই ইস্পাতের সুবাদে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল এই শহর। অর্থনীতি থেকে ক্রীড়া, সংস্কৃতিসব কিছুতেই সমৃদ্ধি লাভ করেছিল কুলটি। কিন্তু সেই ইস্পাত কারখানায় অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সুদিন গিয়েছে এই শহরের। পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে কবে সেই সংস্থা আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এখন যেন তারই অপেক্ষা।
১৮৭০ সালে প্রায় ৮৭২ একর জমির উপরে এক ব্রিটিশ শিল্পপতি কুলটিতে এই ইস্পাত কারখানার গোড়াপত্তন করেন। তখন সেটির নাম ছিল বেঙ্গল আয়রন কোম্পানি। স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (সেল) বিকাশ বিভাগ প্রকাশিত এই কারখানার ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশে এই কারখানাতেই প্রথম লোহা গলানোর চুল্লি বা ব্লাস্ট ফার্নেস তৈরি করা হয়। ১৮৭৫ সালে সেই চুল্লি কাজ শুরু করে। তার পরের বছর এই কারখানার মালিকানা যায় মার্টিন বার্নের হাতে। তখন নামকরণ হয় বরাকর আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড। এর পরে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হন বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে তিনি এই কারখানার মালিকানা পান।
১৯১৮ সালে বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও মার্টিন বার্নের যৌথ উদ্যোগে বার্নপুরে আরও একটি ইস্পাত কারখানা গড়ে ওঠে। সেটির নাম রাখা হয় ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড (ইস্কো)। ১৯৫২ সালে কুলটি থেকে লোহা গলানোর চুল্লি বা ব্লাস্ট ফার্নেসটি বার্নপুরের ইস্কো কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেই বছরই কুলটির কারখানা বার্নপুর ইস্কোর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, ভারতবর্ষে প্রথম কুলটির ইস্কোতেই তৈরি হয়েছিল লোহার স্প্যান পাইপ। ১৯৪৫ সাল থেকে এখানে লোহার পাইপের উত্পাদন শুরু হয়। টানা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পাইপ তৈরি হয়েছে এখানে।
১৯৭২ সালে সরকারের হাতে যায় ইস্কো কারখানা। বর্তমানে সেটি কেন্দ্রীয় ইস্পাত সংস্থা সেলের বিকাশ দফতরের অধীনে রয়েছে। কারখানাটি পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে রুগ্ণ হতে শুরু করে। তাই সেটি বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নেয় ইস্পাত মন্ত্রক। জাতীয়করণের পরে আরও অন্তত ২০ বছর এই কারখানার রমরমা দেখেছেন শিল্পাঞ্চলবাসী। অনেক ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলা সেই কারখানাও কালের নিয়মে পুরনো হয়ে গিয়েছে। আধুনিকতার অভাবে যন্ত্রপাতিগুলি কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে, এক সময়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে সংস্থাটি। কর্তৃপক্ষের তরফে শ্রমিক-কর্মীদের স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। ২০০৩ সালে কারখানার প্রায় তিন হাজার শ্রমিক-কর্মী স্বেচ্ছাবসর নেন। অবশেষে সেই বছরের ৩১ মার্চ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে ইস্পাত মন্ত্রক ফের কারখানাটি খোলার ব্যবস্থা করে। কিন্তু, লোক নিয়োগ করা হয়নি। ঠিকা প্রথায় সামান্য উত্পাদন শুরু হয়েছে। তবে অতীতের সেই রমরমা ফেরেনি।
রাস্তায়, বাজারে, চায়ের দোকানে প্রবীণদের আলোচনায় এখনও উঠে আসে, কারখানার সেই সুদিনে শহরের উজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছ্বল দিনগুলোর কথা। প্রবীণ বাসিন্দাদের কথায়, “সে ছিল এক স্বর্ণযুগ।” কারখানার আর্থিক উন্নতির প্রভাবে এলাকার অর্থনীতি তখন বেশ চাঙ্গা ছিল। ক্রীড়া থেকে সংস্কৃতিসব কিছুতেই যেন শিল্পাঞ্চলের পথ প্রদর্শক ছিল কুলটি। তখনকার সেই শহরের সঙ্গে বর্তমান কুলটির কোনও মিলই এখন খুঁজে পান না প্রবীণেরা। কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই যেগুলো চলে গিয়েছে স্মৃতির অতলে।
ইস্কো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে কুলটি মূলত নির্ভরশীল দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা উত্তোলক সংস্থাইসিএল এবং বিসিসিএলের উপরে। ইসিএলের সোদপুর এরিয়ার বিভিন্ন খনি, বিসিসিএলের দামাগড়িয়া খনি-সহ বিভিন্ন কোলিয়ারিই কার্যত বাঁচিয়ে রেখেছে কুলটির অর্থনীতি। তার সঙ্গে রয়েছে বরাকর ও নিয়ামতপুরের বড় বাজার। তবে সেই সোনালি দিন ফিরবে কি না, ইস্পাত কারখানার উপরেই তা নির্ভর করছে, মনে করেন শহরবাসী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy