Advertisement
E-Paper

ঘরে নয়, বাইরে

প্রায় সত্তর বছর বয়সি স্বাধীনতার আংশিক স্বাদ পেতে হলেও মেয়েদের ‘মুক্তি’ খুঁজতে হবে বিদেশের মাটিতে! বলিউডের নতুন ছক।দাত্তো-র দাঁত উঁচু বলে বিয়েটা হল না’, ভদ্রলোকের গলায় খেদ। আর ভদ্রমহিলা খুশি, ‘ভাগ্যিস! যে ভাবে মনু মজেছিল দাত্তো-তে, তনু-র মতো অমন সুন্দর বউ থাকতে... পুরুষমানুষের স্বভাবই এ রকম।’ তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস দেখতে দেখতে পাশে-বসা মধ্যবয়স্ক দম্পতির লাগাতার তর্ক শুনে যেতেই হল, আপত্তি জানালেও তাঁরা থামবেন না। তবে শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকও মেনে নিলেন যে, বিয়েটা টিকে গিয়ে ভালই হল।

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:৪৩

দাত্তো-র দাঁত উঁচু বলে বিয়েটা হল না’, ভদ্রলোকের গলায় খেদ। আর ভদ্রমহিলা খুশি, ‘ভাগ্যিস! যে ভাবে মনু মজেছিল দাত্তো-তে, তনু-র মতো অমন সুন্দর বউ থাকতে... পুরুষমানুষের স্বভাবই এ রকম।’ তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস দেখতে দেখতে পাশে-বসা মধ্যবয়স্ক দম্পতির লাগাতার তর্ক শুনে যেতেই হল, আপত্তি জানালেও তাঁরা থামবেন না। তবে শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকও মেনে নিলেন যে, বিয়েটা টিকে গিয়ে ভালই হল।

পরিচালক অবশ্য ছবিটা প্রেমের মোড়কেই দেখাতে চেয়েছেন। শেষ দৃশ্যে বিয়ের শেষ পাকে দাত্তোই প্রায় সরব হয়ে মনুর মধ্যে প্রেমিক-সত্তা জাগিয়ে তুলে তাকে তার আগের বউ তনুর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, তার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গে থলে থেকে বেড়াল বেরিয়ে জানিয়ে দেয়, সাত পাকের বাঁধনই অমোঘ, অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য। সোজাসাপ্টা, সরল, টমবয়ের মতো দাত্তো যে খামখেয়ালি সুন্দরী তনুর কাছে হেরে যেতে বাধ্য, সে কথাটাও অমনি খেয়াল করিয়ে দেয়।

বলিউডে এ রীতি বহুকাল ধরে চলে আসছে। ‘অ্যাম্বিশন’ওয়ালা মেয়েদের ‘লাভ লাইফ’ থাকতে নেই, বা থাকলেও পরিণতি নেই। দাত্তো অ্যাথলিট, হরিয়ানার গ্রাম থেকে স্পোর্টস কোটায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল, খানিকটা খ্যাপা, কাজের তাগিদে দৌড়ে বেড়ায়। তাকে দেখে মনুর মতো কোনও পুরুষ যদি বা আকৃষ্ট হয়, নিজের বউয়ের কথা মনে পড়ে যায়, শেষ পর্যন্ত আর যা-ই হোক, তাকে বিয়ে করে উঠতে পারে না। তনু ঘরে না থাকলেও, মনুর মনে তো তার নিত্য যাওয়া-আসা। তা ছাড়া প্রেমের ফাঁদ-পাতা-ভুবনে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তনুর কোনও কাজকর্ম নেই, পেশাই নেই— এমন মেয়েই তো বউ হিসেবে পছন্দ পুরুষের।

কঙ্গনা রানাউত-এর দাত্তোর মতো চরিত্র কিছু কাল আগেই দেখেছি যব তক হ্যায় জান-এ— অনুষ্কা শর্মার আকিরা, দাত্তোর চেয়েও অনেক বেশি দুঃসাহসী বেপরোয়া, ডিসকভারি চ্যানেলের জন্য ডকুমেন্টারি বানানোই তার পেশা, পেশার সুবাদে বিপদ তুচ্ছ করতেও সে প্রস্তুত। তাকে কোনও পুরুষ ভালবাসতেই পারে না, বিয়ে তো দূরের কথা। বলিউড যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়েদের কাজকর্ম বা পেশায় থিতু করে, তখন তাদের প্রেমের পরিণতি পেতে দেয় না। ডার্টি পিকচার্স আর হিরোইন মনে করুন: বিদ্যা বালন আর করিনা কপূরের প্রেমের ব্যর্থ পরিণতি। কিংবা ক’দিন আগের বম্বে ভেলভেট-এর অনুষ্কা শর্মা। আর, প্রেমিকা যদি মদ্যপায়ী-স্বল্পবাস, সর্বোপরি উৎকেন্দ্রিক হয়? ঘনঘোর প্রেম সত্ত্বেও ককটেল-এ দীপিকা পাড়ুকোন সইফ আলি খানের বউ হয়ে উঠতে পারেন না। আর গেছো মেয়ে যে পুরুষের কতটা অপছন্দের, তা তো দুই দশক আগেই কুছ কুছ হোতা হ্যায়-তে জানিয়ে দিয়েছে বলিউড। বাস্কেটবলে শাহরুখকে বলে বলে হারালেও তাঁর প্রেমিকা হিসেবে বাতিল হয়ে যান কাজল, পরে টমবয় ইমেজ ছেড়ে পূর্ণ সুন্দরী হয়ে ফিরে এলে তাঁকে গ্রহণ করেন শাহরুখ। চিত্রাঙ্গদা মনে পড়ছে কি?

উদাহরণ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কয়েকটি মাত্র বাঁধা ছকে সাজানো থাকে এই সব ফিল্মের গল্প, এমনকী সংলাপও। একটাই অভিপ্রায়, গড় দর্শকের কাছে পৌঁছনো। ফলে বাজার বজায় রাখার জন্যে প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধগুলি ছবিতে বুনে দেওয়াই তার কাজ। এ ব্যাপারে তার মস্ত সহায় পিতৃতন্ত্র, যা অলিখিত শর্তে সমাজ শাসন করে। পর্দা আলো-করে-রাখা ঐতিহ্যবাহিনী পেশাহীন মেয়েদের জীবনে পারিবারিকতা থেকে বিবাহ থেকে মাতৃত্ব অবধি সব কিছুকেই আবশ্যিক করে তোলে বলিউড। মেয়েরা প্রেমকে কী ভাবে নিজের জীবনে ঠাঁই দেবে, কতটা উপভোগ করবে, তাও ঠিক করে দেয় পুরুষেরা। মেয়েদের প্রেমজ জীবনের নিয়ন্ত্রক যেন একমাত্র ওই পুরুষেরাই, সে জন্যে ছবিতে তারা অধিকাংশ সময়ই হাজির হয় চালু ব্যবস্থার বার্তা-বয়ে-আনা দেবদূত হিসেবে।

কিন্তু এটাই আজ আর একমাত্র ধারা নয়। অন্য স্বর, বিরুদ্ধ স্বরও শোনা যাচ্ছে। যেমন শোনা গেল আয়েষা-র গলায়। দিল ধড়ক্‌নে দো-র (ছবিতে একটি দৃশ্য) প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত চরিত্রটি যেন সামুদ্রিক ঝোড়ো হাওয়া, বলিউডি পিতৃতন্ত্রের শর্তটর্তগুলো উড়িয়ে দিল প্রায়। কাজ ভালবাসে সে, ইতিমধ্যেই ব্যবসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। প্রবল পারিবারিক চাপ সত্ত্বেও কাজের ক্ষতি হবে বলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়েটি এক্ষুনি মাতৃত্ব চায় না, চুপচাপ গর্ভরোধের ব্যবস্থাও রাখে। সর্বোপরি সে বিবাহবিচ্ছেদ
চায়, স্বামীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থেকে নয়, মা-বাবার চাপিয়ে দেওয়া স্বামীকে কোনও দিনই ভালবাসতে
পারেনি বলে।

এ ছবির পরিচালক জোয়া আখতার মেয়ে, তাঁর সহ-চিত্রনাট্যকার রিমা কাগটিও মেয়ে। দুজনেই বছর চারেক আগে বলিউডকে জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা-র মতো ছবি উপহার দিয়েছিলেন। তাতে নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফ নিজের জীবনেই শুধু পিতৃতন্ত্রের ছক ওলটপালট করেননি, নায়ক হৃতিক রোশনকে সফল পৌরুষের খাঁচা থেকে বের করে এনে বিকল্প বাঁচা শেখান। এখনও অনুপাতে কম, কিন্তু এই ধারার ছবির শুরু নতুন শতকের প্রথম দশকে। দিল চাহতা হ্যায়, কাল হো না হো, সালাম নমস্তে, হম তুম, নীল-এন-নিকি, কভি আলবিদা না কহেনা, লাভ আজকল, এক ম্যায় অওর এক তু... অনেক ছবিতেই সম্পর্কের একটেরে শুদ্ধতা, যৌনতার বিধিবদ্ধ সংস্কার ছেড়ে বেরিয়ে আসছে মেয়েরা। পিতৃতন্ত্রের আওতা থেকে মুক্ত বিকল্প রোমান্স খুঁজে নিচ্ছে, বিয়ে-মাতৃত্বের বাঁধাধরা পারিবারিক প্রথাকে অস্বীকার করছে, এমনকী বছরখানেক আগে কুইন-এর মেয়েটি, কঙ্গনা অভিনীত চরিত্রটি তো নিজের শর্তে অন্দর থেকে বাইরে আসে, বাঁচে, পুরুষ-নির্ভরতার প্রয়োজন হয় না আর।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, বলিউডের এ-সমস্ত ছবিই বিদেশের অনুষঙ্গে বোনা। একুশ শতক যত গড়াচ্ছে, এই যে পিতৃতন্ত্রের ফাঁকফোকর খুঁজে ক্রমাগত ‘স্পেস’ তৈরি করে নিচ্ছে ছবিগুলি, তাতে বিদেশি বাতাবরণের একটা বড় ভূমিকা। কিছু ছবি বিদেশের মাটিতেই বোনা গল্প, কিছু ছবি বিদেশ ভ্রমণের গল্প। পটভূমি বা জলহাওয়া যে মুহূর্তে বিদেশের, অমনি তার দমকা হাওয়ায় সব সংস্কার-অনুশাসন উড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েরা।

পুঁজির চরিত্র আন্তর্জাতিক বলেই কি? পুঁজিই তো শাসন করে বলিউডকে, আর বলিউডের কাজই তো বাজার বাড়ানো, দেশের পাশাপাশি বিদেশেও। সেই বিশ্বায়িত পুঁজি চাইছে মা-বাবা-নির্ভর সামাজিক পারিবারিক ঐতিহ্যের আদল ভেঙে দিয়ে দর্শককে স্বাধীন ইচ্ছার নিয়ন্ত্রক করে তুলতে, তাতে সনাতনী ভারতীয়তার বাধা থাকা চলবে না। এ ভাবে ‘গ্লোবাল’ হলে মুনাফার দিগন্তও প্রসারিত হবে।

সুতরাং, প্রায় সত্তর বছর বয়সি স্বাধীনতার আংশিক স্বাদ পেতে হলেও মেয়েদের ‘মুক্তি’ খুঁজতে হবে বিদেশের মাটিতে! বলিউডের নিদান। নতুন ছকও বলতে পারেন।

shiladitya sen tanu weds manu bollywood Kangana Ranaut anushka sharma Farhan Akhtar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy