Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

যুক্তি থেকে মুক্তি

সলমন খান আইনকে কলা দেখাচ্ছে, বাবুল সুপ্রিয় স্টাইনকে। আমি কলা দেখাই সমস্ত মানবিকতাকে আর মাত্রাজ্ঞানকে।এমনিতে সভ্যতার বোম্‌কে যাওয়ার খ্যামতা বিলুপ্ত। শিল্পে বলো আর বাস্তবে, যা যা হওয়ার ছিল, সব ঘটে গেছে। আচাভুয়া পেন্টিং হয়েছে, বহুত ঘুরেফিরে দেখেও বোঝাই সম্ভব না এটা পাকস্থলী না পেঙ্গুইন। উদ্ভট সিনেমা হয়েছে, যা রঙিন কিন্তু পপকর্নের দিকে এক সেকেন্ড মন দিয়ে যেই ফিরে তাকিয়েছ, ওমা, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট!

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

এমনিতে সভ্যতার বোম্‌কে যাওয়ার খ্যামতা বিলুপ্ত। শিল্পে বলো আর বাস্তবে, যা যা হওয়ার ছিল, সব ঘটে গেছে। আচাভুয়া পেন্টিং হয়েছে, বহুত ঘুরেফিরে দেখেও বোঝাই সম্ভব না এটা পাকস্থলী না পেঙ্গুইন। উদ্ভট সিনেমা হয়েছে, যা রঙিন কিন্তু পপকর্নের দিকে এক সেকেন্ড মন দিয়ে যেই ফিরে তাকিয়েছ, ওমা, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট! মানুষের কল্পনার একেবারে তলানি অবধি খরচা হয়ে গেছে। আর বাস্তব? সে তো সাতাশ কাঠি সরেস। তুমি ভাবলে ধর্ষণের শেষ দেখে ফেলেছ, তাপ্পর শুনলে এক বছরের মেয়েকে ভোগ করা হচ্ছে। ভাবলে মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনির চূড়ান্ত কাণ্ডাকাণ্ড দেখেছ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, শুনলে মায়ানমারের রিফিউজিরা জাহাজে পরিত্যক্ত, কেউ তাদের নেবে না, তারা সমুদ্রের ওপর ভাসছে ও নিজেদের হিসি খেয়ে তেষ্টা মেটাচ্ছে। অর্থাৎ, এক্সক্লেমেশন মার্কের হদ্দমুদ্দ হয়ে গেছে। মানুষ এখন বোম ফাটলে বলে, অঃ। ভূমিকম্প হলে হাই তুলে বলে, এ তো রোজই হচ্ছে, তোরা পালিয়ে নীচে যা, আমি এই সিনটা দেখে আসছি! তাইলে প্রশ্ন হল, বিস্ময়ে ক্যায়সে ডিগবাজি খাবে তার প্রাণ? কোন ব্রেকিং নিউজ তাকে ধাঁ করে স্ট্যাচু বানিয়ে দেবে? সেই দায়িত্ব নিয়ে ধরাধামে বিরাজ করছি আমি। হ্যাঁ, একা, একক, একেশ্বর অ্যাকঅ্যাকে! উত্তর কোরিয়াকে কব্জা করিয়া এমন কীর্তি ঘড়ি ঘড়ি রচছি ইতিহাস বইয়ে, কুর্নিশ পাঠাচ্ছে অমর আত্তিলা, চমৎকার চেঙ্গিজ।

এমনিতে আমাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই, মিথের শেষ নেই, হিংসেরও শেষ নেই। আজকের যুগে এমন একটা স্বৈরাচারী ডংকা মেরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমেরিকার অবধি সাধ্যি নেই তার খোঁচা-খোঁচা চুলে একটি উকুন ছেড়ে দেওয়ার, এ তো ইতিহাসের ইলেকট্রিক! সেই আগেকার রাশিয়ার মতো দেশের সাইডে আখাম্বা লৌহপর্দা ফেলে রেখেছি, ফাঁক দিয়ে কিস্যুটি ইনফর্মেশন বেরোয় না। তবে মাঝে মাঝে, কুকুরকে মাংস ছোড়ার মতো, এক-আধটা দড়াম সাপ্লাই করি।

যখন হঠাৎ ফতোয়া দিই, আমার নামটা সারা দেশে আর কোনও পুরুষের যাতে না থাকে এক্ষুনি তার ব্যবস্থা করো, মানুষের রিয়েল তিড়িতঙ্ক লাগে। আরে, আমাকে তো নিউজের মতো নিউজ রান্না করতে হবে। আমার তো কম্পিটিশন আছে রে বাবা! সলমন খান আইনকে কলা দেখাচ্ছে, বাবুল সুপ্রিয় স্টাইনকে। আমি কলা দেখাই সমস্ত মানবিকতাকে আর মাত্রাজ্ঞানকে। জাস্ট গত মাসে, আমার বাবার মৃত্যুর তিন বছর যেই না কেটে গেছে, শোক-পিরিয়ড শেষ, বললাম, নারী লাও! মানে, আমার ঠাকুদ্দা যা চালু করেছিল, সেই ‘প্লেজার-ট্রুপ’ ফির সে বহাল হবে। সরকারি কর্মচারী গ্রুপ গাঁয়েগঞ্জে খোঁজ লাগাও, ডবকা সুন্দরীদের এনে আমার পায়ের কাছে ফেলো। আমি বেছে নেব, কে হবে দাসী, কে পোষা নাচিয়ে, আর কে আমার কোলেকাঁখে শুয়েবসে আনন্দ বিলোবে। তবে এটাও একটু ক্লিশে। আরবে শেখরা তো এই ফিল্ডে একেবারে একাশি গোল! পাবলিকের আন্তরিক ‘আঁক্‌স!’ আদায় করতে গেলে একমাত্তর উপায় হল খুন। সরল খুন আমি বহুত করেছি। ডাইনে-বাঁয়ে। ক্ষমতা নেওয়ার সময় যতগুলো পরামর্শম্যান ছিল, ভারী ভারী সব অমাত্য, আমির, ওমরা— এখন সিংহাসনের কয়েকশো মাইলের মধ্যেও নেই। নিজের কাকাকেও কোতল করলাম। যারা খুন হয়নি, ক্যাম্পে আছে। যেখানে থাকলে, লোকে কাতরায়, প্লিজ খুন করো বাপ।

কিন্তু এ বার করব জটিল খুন। নিজের কাজটাকে এনজয় করতে গেলেও তো নিজেকে বদলাতে হয়। তাই ভেবেচিন্তে এই ঘটনাটা ঘটালাম। একটা সভায় গেছি, আমার একটা মন্ত্রী দেখি এর-তার সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলছে। আমি সামনে থাকতে, কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে! এনিবডির সাথে! তার পর সে কী করল! সভা চলাকালীন ঘুমিয়ে পড়ল! ঘুম! মানে, একদম আমার অস্তিত্বটাই অস্বীকার! আমার সভার কাজটাকে চূড়ান্ত ফুঃ! আমি কী শাস্তি দিলাম? আরে খুন তো করলামই, কিন্তু আসলি কথা হল, তার তরিকাখান। খুন তো তরমুজ কাটার ছুরি দিয়েও করা যায়, রাইফেল তাক করেও। আমি ব্যাটাকে খুন করলাম কিনা অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্‌ট বন্দুক দিয়ে! মানে, যা একটা গোটা প্লেনকে আকাশ থেকে ছিঁড়েখুঁড়ে নামিয়ে দিতে পারে! খুন না বলে ফটাস-ফাট্টু বলাই ভাল। প্রায় শ’খানেক লোকের সামনে বডিটা ক’পিস হয়ে উড়ে গেল, গুনতে বললে আর্কিমিডিসও হেঁচকি তুলে হাঁ। কোনও দর্শকের বমি করার বা মুচ্ছো যাওয়ার সাহস হয়নি অবশ্য। তাইলে বেচারা বন্দুকটাকে ফের ডিউটি দিতে হত।

অনেকে বলছে, লঘু পাপে গুরু দণ্ড! নির্ঘাত লোকটার সঙ্গে ডিক্টেটরের অন্য শত্রুতা ছিল। মানে, এই কাজের অ্যাবসার্ডিটি-টা হজম করতে পারছে না। গাধাগুলোর মূল খামতিটা হল, স্বৈরাচারীর কাজে যুক্তি খুঁজছে। যেখানে স্বৈরাচারীর মূল প্রোজেক্টটাই হল: যুক্তি থেকে স্বাধীনতা। যুক্তির দায় থেকে পূর্ণ মুক্তি। সেটাই ক্ষমতার আল্টিমেট উড়ান। যদি আমার নিষ্ঠুরতার পেছনে যথাযথ মোটিভেশনই থাকত, অংকের হিসেব-মাপা বিচার থাকত, তা হলে তো আমার জমানা পেত গণতন্ত্রেরই একটা বাঁটকু চেহারা। তাতে তছনছিয়া মজা কই? সুপার-শিল্পীর মতো, ডিক্টেটরেরও অন্তিম লক্ষ্য: নিজের মনের যেখানটায় কোনও সভ্যতার, সমাজের আলো পৌঁছয়নি, সেইটাকে লাগাম তুলে দেওয়া। বাচ্চারা চূড়ান্ত স্বাধীন, তারা অর্থহীন শব্দে ঝগড়া করে, আঁকার সময় ঘোড়ার ধড়ে অনায়াসে মুরগির মাথা বসিয়ে দেয়। বাস্তবে এটা করতে কে পারে? একমাত্র ডিক্টেটর। তাকেও নিজেকে এই শিশুপনায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কার্য-কারণ দড়িদড়া ছিঁড়ে ফেলতে হবে, খাঁটি ফ্যান্টাসিকে পুজো করতে হবে। পৃথিবীতে কী হয়, তাকে গুলি মেরে এমন একটা পৃথিবী তৈরি করতে হবে, যা তার খামখেয়ালকে আঁকড়ে এইমাত্র গজিয়ে উঠছে।

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE