বিমলমতিলাল! তে/ সমলমতিনা ময়া
বিমতিমলমার্জনে/ ত্বমলমিতি চিন্ত্যতে
যদি-তর্ক
বিমলকৃষ্ণ মতিলালের জন্ম ১ জুন। মৃত্যু ৮ জুন। মাঝে ছাপ্পান্ন বছর সাত দিন। ১৯৯১-এর ৮ জুন তারিখটি আবার চব্বিশ বছর পরে ফিরে এল। ‘ওই তারিখটিই ফিরে এল’, এই কথাটাকে কী ভাবে ঠিক বোঝা যায়? যে রজনী যায়, সে তো আর ফিরে আসে না, এই অমোঘ অপুনরাবৃত্তির তত্ত্ব মনে রেখেও তা নিয়ে একমাত্র বিমলকৃষ্ণের সঙ্গেই আলোচনা করা যেত। জমিয়ে। মুড়ি, করবী মতিলালের ভাজা বাঁধাকপির পেঁয়াজি (স্যর ছিলেন বাঁধাকপির ভক্ত, আর আমি পেঁয়াজ খেতাম না কিন্তু তেলেভাজার ভক্ত ছিলাম, গুরুপত্নীর ওই ছিল কমপ্রোমাইজ সমাধান), ভাল দার্জিলিং চা, হ্বিটগেনস্টাইন, বিমলবাবুর মাস্টারমশাই কোয়াইন-এর বই এবং ভাষাপরিচ্ছেদ মুক্তাবলীর টেক্সট সহযোগে ‘চব্বিশ বছর পর ওই দিনটিই ফিরে এসেছে’, এই বাক্যটির মানে বিশ্লেষণ করা যেত। যদি না উনি অত কষ্ট পেতে পেতে শিরদাঁড়ার ভিতরে মজ্জার ক্যানসারে মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে মারা যেতেন।
কিন্তু যখন মারা গিয়েছেন, এটা সর্বজনবিদিত অকাট্য ঘটনা, তখন তার বিপরীতে গিয়ে ‘যদি মারা না যেতেন তা হলে উনি ‘পারসেপশন’-এর পরে ‘ইনফারেন্স’ নামে একখানা বই অবশ্যই লিখতেন’, এমন কল্পনার কী মানে হয়? অথচ এই ধরনের বাস্তবঘটনাবিরোধী ‘যদি ক না হত তা হলে খ হত না’ জাতীয় শর্তমূলক বাক্য প্রয়োগ করে আমরা যে যুক্তি দিই, তাকেই ন্যায়দর্শনে বলা হয়েছে ‘তর্ক’। কার্যকারণসম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘যদি পার্ল হারবারে জাপানি আক্রমণ না হত তা হলে ওই সময়ে আমেরিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যোগ দিত না’— এ জাতীয় তর্ক আকছার ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৫’তে হার্ভার্ডে ডক্টরেট করার আগে কলকাতা সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যাপক তরুণ এম এ পাশ বিমলকৃষ্ণ ছিলেন প্রাইজ পাওয়া ‘তর্কতীর্থ’। তীর্থ মানে ঘাট। বিমলকৃষ্ণের ঘাট না থাকলে আমি বা আমার অধ্যাপক প্রবাল কুমার সেন, আমরা কেউই ন্যায়শাস্ত্রের গভীর স্রোতস্বিনী নদীতে নামার সাহস পেতাম না। তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যার্থীর কাছে তর্ক-নদীর সুগম ধাপে ধাপে বিন্যস্ত ‘তীর্থ’ হয়ে থাকবেন।
বিশ শতকের শেষ দিকে এই বাস্তবঘটনাবিরুদ্ধ ‘কী হলে কী হবে’ (কাউন্টারফ্যাকচুয়াল কন্ডিশনাল) নিয়ে পশ্চিমী লজিকে বিস্তর লড়ালড়ি হয়ে গেছে। এই ঘটমান বিশ্বে যা হয়নি, অন্যান্য অঘটিত সম্ভাব্য বিশ্বে অন্য পসিব্ল ওয়ার্ল্ড-এ তার ও তার পরিণামে অন্য ঘটতে-পারত-কিন্তু-ঘটেনি ব্যাপারের বর্ণনাই কি এই সব ‘যদি, তা হলে’ তর্কের কাজ? সল্ ক্রিপকে, ডেভিড লিউইস প্রভৃতি দার্শনিক যুক্তিবিজ্ঞানীর সে-সব গবেষণা আলোচনা করতে করতে অল সোল্স কলেজে অধ্যাপক মতিলাল মেনে নিতেন যে এই জাতীয় (লাইবনিত্স প্রথম এই বিশ্বান্তর— অন্য পসিব্ল ওয়ার্ল্ড-এর কথা পশ্চিমী দর্শনের মাথায় ঢুকিয়ে দেন, সে-ও জগত্ভরা দুঃখকষ্ট ও বদমায়েশি কী করে এক জন সর্বশক্তিমান মঙ্গলময় ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন, এই সমস্যার এক গোঁজামিল সমাধানেনের জন্য) অঘটিত বিশ্বান্তরের চিন্তা চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ, নৈয়ায়িক, মীমাংসক, বৈদান্তিক, কেউ কস্মিনকালেও করেননি। কিন্তু তাই বলে ‘নেতাজি অন্তর্হিত না হলে পরে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রগঠন অন্য রকম হত’ অথবা ‘আগুন ছাড়াও যদি ধোঁয়া হত তা হলে বরফের সিগারেট দ্বারা ধূমপান সম্ভব হত’ ইত্যাদি জাতীয় তর্কের লজিক নিয়ে যে ভারতীয় নৈয়ায়িকরা ভাবেননি, এমন কথা বিমলকৃষ্ণ মেনে নিতেন না। উদয়নের ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ খুলে উনি আমাদের বুঝিয়েছিলেন, কেমন করে চার্বাকের কথার জবাব দিতে গিয়ে নৈয়ায়িকদের ‘তর্ক’-এর আশ্রয় নিতে হয়েছে। একটি প্রমাণলব্ধ বিশ্বাসকে সংশয় করতেই পারে বিচারনিপুণ দার্শনিক, কিন্তু সংশয়ের সীমা বেঁধে দেয় অনুকূল তর্ক। যদিও, তর্ক কিন্তু ‘প্রমাণ’ নয়, ওটা এক রকমের প্রমাণের সহকারী, সমর্থক, ‘যেখানে ধোঁয়া সেখানেই আগুন’ জাতীয় সামান্যীকরণের বলবৃদ্ধিকারী বিচারের উপায়। এই জাতীয় সামান্যীকরণের বিরুদ্ধেই ‘যা চোখে দেখিনি তা মানি না’-বাদী চার্বাকের আপত্তি।
চার্বাকদের আপত্তির কথাটা তোলবার আগে একটা জিনিস লক্ষ করাতে চাই। ‘যদি বিমলবাবু চব্বিশ বছর আগে ৮ জুন মারা না যেতেন, তা হলে এই এই ব্যাপার হত অথবা হত না’, এই জাতীয় চিন্তাকে আমি প্রথমেই সাধারণ ভাবে বলেছি কল্পনা। জেনে শুনে, ঘটনার রাজ্য ছেড়ে, যা ঘটেনি তার চিন্তা করাকে তো কল্পনাই বলে। অথচ এই চিন্তারই টেকনিক্যাল নাম ‘তর্ক’। তা হলে কল্পনা আর তর্ক, ইমাজিনেশন আর রিজ্নিং, এই দুটোকে আমরা বিপরীত মনে করি কেন? বিমলবাবুর এক জন ‘হিরো’ ছিলেন চৈতন্যসমসাময়িক রঘুনাথ শিরোমণি। তিনি বাঙালির নামে গর্ব করে লিখেছিলেন, ‘তর্কে কর্কশবুদ্ধি, মানে তীক্ষ্ণধী, খরখরে যুক্তিখণ্ডনকারী ধারালো বুদ্ধি, কারা? আমরাই। আর কাব্যে কোমলবুদ্ধি, কবিকল্পনায় মন-গলানো কোমল মাখনের মতো বুদ্ধি, কাদের? আমাদেরই।’ তা হলে কল্পনা আর তর্ক একই জিনিস, অন্তত বিপরীত নয়। তার জন্য বিনয় মজুমদারে যাওয়ারও দরকার নেই, শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাটি, অন্তত এর প্রথম লাইনটুকু একটি নিরলঙ্কার কাউন্টারফ্যাকচুয়াল কন্ডিশনাল: ‘হঠাত্ কখনো যদি বোকা হয়ে যায় কেউ, সে তো নিজে আর/ বুঝতেও পারে না সেটা। যদি বুঝতোই তা হলে তো বুঝদারই/ বলা যেতো তাকে। তাই যদি, তবে/ তুমিও যে বোকা নও কীভাবে তা বুঝলে বলো তো?’ (‘বোঝা’, লাইনেই ছিলাম বাবা, পৃ ২০) এক জন মানুষ কবি তাঁর মানুষী প্রেয়সী বিষয়ে যখন লেখেন ‘আমি যদি হতাম বনহংস বনহংসী হতে যদি তুমি/ তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে...’ তখন তো তিনি কাউন্টারফ্যাকচুয়াল তর্কই করছেন। অথচ জীবনানন্দ দাশ তর্ক করছেন এ কথা বললে কবি ও তার্কিক উভয় সমাজেই হাসির পাত্র হতে হয়। কেন?
‘গিন্নি দ্যাখো! নেকড়ে বাঘের পায়ের ছাপ’
প্রত্যক্ষ আর অনুমান, এই দুটো প্রমাণ, সত্য জ্ঞান লাভ করবার দুটি উপায় বা ‘করণ’— ভারতীয় দর্শনে চার্বাক ছাড়া সকলেই মানেন। চোখ মেলে দেখি আকাশে মেঘ করেছে। কিন্তু বৃষ্টি হবে বা ঝড় হবে তা হওয়ার আগেই জেনে ফেলি অনুমানের দ্বারা। অতীত, ভবিষ্যত্, দূরদেশের বা দূর মহাজগতের কথা জানার জন্য অনুমান ছাড়া উপায় নেই। ইতিহাসের তথ্য আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস, এ সবই তো অনুমান দিয়েই পাই। অথচ চার্বাকরা বরাবর বলে এসেছেন, ইন্দ্রিয় দ্বারা সাক্ষাত্ প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনও প্রমাণ মানা যায় না। আসলে ওঁরা তো দেহ আর জড় ইটকাঠমাটিপাথরের জগত্ ছাড়া আর কিছু মানতে চান না (পরমাণুর ভিতরে ইলেকট্রন অথবা তদপেক্ষাও সূক্ষ্মতর কোয়ার্ক আর এই সব কণিকার ঘূর্ণিমূল্য তো চার্বাকদের কথা শুনলে আমাদের জ্ঞানের মধ্যেই আসবে না, কারণ এগুলির তো প্রত্যক্ষ হয় না)। ওঁদের ভয় হল, এক বার চোখের দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে অনুমানে ভরসা করলেই আত্মা, পরলোক, ঈশ্বর, পুনর্জন্ম ইত্যাদি দক্ষিণালোভী বামুনদের আজগুবি কথায় কান দিতে হবে। কিন্তু যে ব্রাহ্মণপণ্ডিতদের হাতে বিমলকৃষ্ণ মতিলালের তর্ক-রসিক দার্শনিকতার দীক্ষা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন অনন্ত তর্কতীর্থ, যিনি প্রথম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘চার্বাকদর্শন’ লিখে বাংলা ‘দর্শন’ পত্রিকায় ছাপান।
চার্বাকদের অনুমান প্রমাণ অস্বীকার করার মোদ্দা যুক্তিটা একটু সহজ করে শোনা যাক। আমরা দূর পাহাড়ের জঙ্গলে ধোঁয়া উঠছে দেখে না-দেখতে-পাওয়া আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। কী করে? পাহাড়টা হল ‘পক্ষ’। ধোঁয়াটা চিহ্ন বা ‘হেতু’। আর আগুনটা ‘সাধ্য’। ‘যেখানে যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হতেই পারে না’, এই নিঃশর্ত সহচার-নিয়মকে বলে ‘ব্যাপ্তি’। এই ব্যাপ্তি আমরা জানব কী করে? চার্বাকদের এই প্রশ্ন চার্বাকদের হাজার দেড়েক বছর পরে জন স্টুয়ার্ট মিলেরও প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল (ভারত শোষণকারী ভারতীয় বিদ্যাবিধ্বংসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে এই মিল সাহেবের কাছ থেকে বঙ্কিমচন্দ্র ও ইয়ং বেঙ্গল ‘উপযোগবাদ’ ও ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র শিক্ষা পেলেও ইনি নিজে কখনও কল্পনা করতে পারতেন না যে, ভারতীয় নৈয়ায়িক বা চার্বাক দার্শনিকদের কাছ থেকে তাঁর কিছু শিখবার থাকতে পারে)। চার্বাকদের প্রশ্ন হল, এই সার্বত্রিক ব্যাপ্তি-নিয়ম— ‘যেখানেই হেতুটা থাকবে সেখানেই সাধ্যটাও থাকবে’— এটা কোন প্রমাণের দ্বারা জানা যাবে? অবশ্যই প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যাবে না। প্রত্যক্ষের দ্বারা তো কেবল বর্তমানে যা দেখা, শোনা, ছোঁয়া, শোঁকা, চাখা যাচ্ছে, তাকেই জানা যায়। যদি লক্ষ বারও দেখে থাকি যে ধোঁয়া আর আগুন এক জায়গায় থাকে, তবুও, কোনও অনাগত কালে এর ব্যতিক্রম হবে না, অগ্নিহীন ধূম পাওয়া যাবে না— এমন কী গ্যারান্টি আছে? যদি বলা যায় ‘যা আজ পর্যন্ত কখনও দেখা যায়নি তা ভবিষ্যতেও কখনও হবে না’, এই নিয়ম থেকেই ব্যাপ্তি জানা যায়, সে তো নিতান্তই ছেঁদো কথা। দুশো বছর আগেও হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষ হাতের তেলোয় ধরা টেলিফোনের পর্দার মধ্যে বসে কথা বলবে, এ কথা দেখা তো দূরের কথা, কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এখন তো ওটা জলভাত। বাচ্চারা পাশে বসা বাবা-মা’র থেকেও কম্পিউটার আর চালাকফোনে দৃশ্যমান শ্রূয়মাণ বন্ধুবান্ধবীর সঙ্গেই বেশিক্ষণ সময় কাটায়, তাদেরই বেশি নিকট বলে মনে করে। উল্টোটাও বলা যায় না, যে যে ধরনের অসুখ করলে মৃত্যু সহস্র বছর ধরে শত শত বার অবধারিত দেখা গেছে সেই ধরনের অসুখ আর মৃত্যু বরাবরই সহভাবী হবে। ব্যতিক্রম হতেই পারে, অদেখা ভবিষ্যতে। অনুমান প্রমাণ দিয়েই ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা বা ব্যাপ্তিকে জানা যায়, এ কথা বললে তো সেটা খুব বিচ্ছিরি রকমের চক্রক বা অন্যোন্যাশ্রয় দোষ হল। অনুমানকে আদৌ প্রমাণ মানব কি না, তা যদি ঠিক করতে হয় অনুমানকে প্রমাণ বলে আগে মেনে নিয়ে, তা হলে তো সিপিএম কর্মীরা নির্ভরযোগ্য কারণ এক জন সিপিএমকর্মী এই কথা বলেছেন— এ রকম কাঁচা যুক্তি হল।
চার্বাকদের এই জোরাল আপত্তির সামনে শুধু নৈয়ায়িক কেন, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রমাণতাত্ত্বিকরাও দাঁড়াতে পারেন কি না সন্দেহ। বিশ শতকের মাঝামাঝি কার্ল পপার ‘লজিক অব সায়েন্টিফিক ডিসকভারি’ বইয়ে একটি ভিত-নাড়ানো আপত্তি তুলেছিলেন পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের একটি প্রধান প্রমাণ পদ্ধতির বিরুদ্ধে। এর নাম ‘হাইপথেটিকো-ডিডাকটিভ মেথড’। একটা এলাকায় বার বার একটা ঘটনা ঘটছে, ধরা যাক পর পর জন্ডিসে স্কুলের বাচ্চারা পটাপট মারা যাচ্ছে। কারণ জানার জন্য একটা প্রকল্প বা হাইপথিসিস করা হল। এ বার এই প্রকল্পকে যাচাই করা যাবে কী করে? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে, বিশেষত শারীরবিজ্ঞানে ও চিকিৎসাশাস্ত্রে এই যাচাই বা সত্যতাসাধক প্রমাণপদ্ধতি হচ্ছে এই রকম। ধরা যাক প্রকল্প করা হল— রাস্তায় ভাজা এগরোল খেয়ে জন্ডিস হচ্ছে। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া যাক ‘এগরোল’। যদি এগরোল সত্যি হয়, তা হলে তার থেকে একটি পরিণাম বা ফল অনিবার্য ভাবে নিঃসৃত হবে এটা তর্ক দিয়ে জানা গেল। এ বার কয়েকটি নীরোগ বাচ্চাকে রাস্তায় এগরোল খাইয়ে পরীক্ষাগারে রেখে দেখা গেল সত্যিই তাদের জন্ডিস হচ্ছে। ব্যস, প্রকল্প সত্য প্রমাণিত হল! কিন্তু ব্যাপারটা যতটাই সহজ মনে হচ্ছে ততটাই নড়বড়ে ও অযৌক্তিক। কারণ সব দেশের সব কালের লজিক এ কথাই বলে যে, ‘যদি ক হয় তা হলে খ হবে, আর ক হয়েছে, অতএব খ হয়েছে’— এটা অকাট্য অভ্রান্ত যুক্তি। কিন্তু ‘যদি ক হয় তা হলে খ হবে, আর খ হয়েছে, অতএব নিশ্চয়ই ক হয়েছিল’— এই উল্টোটা একেবারেই ভুল যুক্তি। বিজ্ঞানের অনুমানগুলি তা হলে সব দাঁড়িয়ে আছে এ হেন হেত্বাভাস বা ফ্যালাসির উপরে।
চার্বাকরা বৈজ্ঞানিকের কার্য থেকে কারণ অনুমান করা (সিম্পটম থেকে রোগের নিদান অনুমান করা)-এর বিরুদ্ধে এই আপত্তিটাই এনেছিলেন। একটি মজার গল্প দিয়ে এটা প্রাচীন-খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম ভাগ থেকে ওঁরা বোঝাতেন। এক চার্বাক সংশয়বাদীর গৃহিণী সব ‘বৈজ্ঞানিক’ পণ্ডিতদের কথায় বিশ্বাস করেন। গৃহিণী শুনেছেন, শহরে রোজ রাতে নেকড়ে বাঘ বেরোচ্ছে। বৈজ্ঞানিকরা অনুমান করছেন। চার্বাক বলেন, ‘ওই নেকড়ে বাঘটাকে কেউ কি নিজের চোখে দেখেছে?’ ‘না, কিন্তু অনেক অনুমান করার ভাল হেতু আছে, তাই এটা প্রমাণিত সত্য।’ মাঝরাতে নগরবাসীরা যখন ঘুমন্ত, চার্বাকমশাই উঠে রাস্তার ধূলিকাদায় হাত মুঠো করে ছাপ ছাপ ফেলে চলে এলেন। সকালে রাস্তার মোড়ে বিরাট ভিড়। বড় বড় জন্তুবিজ্ঞানীরা আতসকাচ দিয়ে মাটিতে ‘পায়ের ছাপ’ পরীক্ষা করে বলছেন, ‘যদি নেকড়ে বাঘ আসত তা হলে এই রকম পদচিহ্ন পড়ত, পদচিহ্ন দেখা গেছে অতএব নেকড়ে বাঘ এসেছিল।’ চার্বাকবাবু সস্ত্রীক ভিড়ের মধ্যে ঢুকে নিজের কীর্তির কথা ফিসফিস করে বলে কনুই মেরে বললেন, ‘গিন্নি, দেখ দেখ নেকড়ের পায়ের ছাপ’। সংস্কৃত প্রমাণদর্শনে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘ভদ্রে বৃকপদং পশ্য’। (হরিভদ্রসূরির ষড়দর্শনসমুচ্চয়ের ‘লোকায়তমত’ দ্রষ্টব্য)
(চলবে)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই, মানোয়া’য় দর্শনের শিক্ষক; প্রতিকৃতিটি লেখকের নিজের আঁকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy